সব
লাউয়াছড়াকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণার পর এই বনের প্রতি মানুষের আগ্রহ যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে দ’খলও। স্থানীয় সং’সদ সদস্য, জনপ্রতিনিধিরা বাগান করার নামে দ’খল করছেন সংরক্ষিত এই বনের জমি। সব জেনেও চুপ থাকতে বা’ধ্য হচ্ছে বন বিভাগ। এতে বন হারাচ্ছে বৈচিত্র্য। হু’মকির মুখে পড়েছে বন্যপ্রা’ণী ও স্থানীয় বনজীবীরা।একশ’ বছর ধরে গড়ে উঠেছে মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া বন। বনরক্ষী হায়দার আলীর ভাষায়, বন আর আগের মতো নাই। এখন অনেক সতর্ক থাকতে হয়। কখন কী হয়ে যায়?
কেনো দিনে দিনে হায়দার আলীর মতো বনরক্ষীদের বন পাহারা দেয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে? তার সঙ্গে কথা হচ্ছিলো বনের পূবদিকটায়, শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সড়কের পাশে। রাস্তার ওপাড়ে বন থাকলেও সেদিকটা আমাদের নিয়ে যেতে ভ’য় পান হায়দার। বলেন, ওই চা বাগানের দিকে যেতে পারবো না। স’মস্যা আছে।কী স’মস্যা জানতে চাইলে বলেন, এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন স্যারেরা বলতে পারবে।
পাখির শব্দের মূর্ছনা ছাপিয়ে আমাদের চোখ আ’টকে থাকে ওই চা বাগানের দিকে। ও’পর থেকে দেখার চেষ্টা করি। ব্যবহার করি ড্রো’নও। এখানে বন আর চা বাগান মিলেমিশে একাকার; সীমানা না থাকায় বোঝা কঠিন, কোনটি বনের জমি; কোনটি চা-বাগানের। ক্যামেরা দেখে ছুটে আসেন ‘সাবারি ট্রি প্লানটেশন’ চা বাগানের ম্যানেজার দেলোয়ার। তিনি জানান, স্থানীয় সং’সদ সদস্য আব্দুস শহীদের চা বাগান এটি। সাড়ে সাত একর জমিতে বাগান করা হয়েছে বলে জানান তিনি। জায়গা এতটুকুই কিনা জানতে চাইলে বলেন, আরেকটু বড় হতে পারে। একটি পিলার দেখিয়ে বলেন, সে পর্যন্ত আমাদের জায়গা। এরপর ফরেস্টের জায়গা।
বাগানের জমি কতটুকু তা জানতে আমরা দেখা করি, বাগানের মালিক ও মৌলভীবাজার-৪ আসনের সং’সদ সদস্য আব্দুস শহীদের সঙ্গে। তিনি জানালেন সাত নয়, দশ একরের মতো জমি আছে সেখানে। জমিটি কীভাবে নিলেন জানতে চাইলে বলেন, এগুলো আমার কেনা জমি। একজন বেচেছিলো আমাকে।শখের বশে চা বাগান করলেও সেটি আরো বাড়ানোর ইচ্ছের কথা জানালেন জাতীয় সং’সদের সাবেক এই চিফ হুইপ।
সাড়ে সাত নাকি দশ একর- বাগানের কেনা জমি আসলে কতটুকু? দুই ধরনের তথ্যে বিভ্রান্ত হয়ে আমরা ছুটে যাই কমলগঞ্জ সাব রেজিস্ট্রি অফিস। দাগ নম্বর ধরে চা বাগানের দলিলটি খুঁজে বের করি। দলিলটি চার বছর আগের। জমির মালিক ছিলেন নাজমুর রহমান শাহীন। মাত্র সাড়ে এগারো লাখ টাকায় জমিটি নিজ নামে কিনে নেন উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ। দেখে আশ্চর্য হতে হয়, এখানে জমির পরিমান চার একরের কিছু বেশি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দশ একর জমি তিনি পেলেন কোথায়?
এরপর আমরা যাই কমলগঞ্জ ভূমি অফিস। সং’সদ সদস্যের কেনা জমিটির দাগ নম্বর ধরে আশেপাশের জমির মালিকের খোঁজ করি। নামানো হয় রেকর্ড বুক।কমলগঞ্জ ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার শামসুল হুদা জানান, এমপির জমির একপাশে খেতের জমি আর দু’পাশে রিজার্ভ ফরেস্টের জমি।
অর্থাৎ সংসসদ সদস্য চার একরের বাইরে কোনো জমি কেনেননি; তিনি বনের জমি দ’খল করেছেন। বি’ষয়টি আরো পরিস্কার হয়, স্যাটেলাইটের ছবি দিয়ে। ২০১৮ সালের সেই চা বাগানের ছবি আর চার বছর পর বর্তমান ছবির তুলনা করে স্পষ্ট দেখা গেছে সং’সদ সদস্যের বাগানের পেটে কীভাবে বন ঢুকে গেছে।স্যাটেলাইট ইমেজ: বাম পাশে ২০১৮ সালের ছবি। ডান পাশে চারবছর পরের ছবি। বন দ’খলের চিত্র এখানেও স্পষ্ট।
প্রশ্ন হচ্ছে, বনবিভাগ কি এটি দেখেনি? আমরা ঢাকার বনবিভাগ অফিস থেকে লাউয়াছড়া বন দ’খলদারদের একটি তালিকা পাই।এই তালিকায় সং’সদ সদস্যের নাম নেই। নেই অন্যকোনো প্রভাবশালীর নামও। আছে দ’খলদার হিসেবে কিছু গ্রামবাসীর নাম। বিস্তারিত জানতে আমরা যেতে চাই, মৌলভীবাজার বনবিভাগের অফিসে।
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী জানান, দুই বছরের কিছু বেশি সময় ধরে তিনি লাউয়াছড়ার পুরো বনটির দায়িত্বে আছেন। সং’সদ সদস্যের চা বাগানের জমি নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বিব্রত হন।
সং’সদ সদস্যের চা বাগানের টিলাটা পুরোটাই কেনা কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ওনার বলেই তো জানি। এখন এর মধ্যে কোনো কিছু আছে কিনা, এই রিপোর্ট আমার কাছে নেই। আমি জানি না। আপনার কাছে কিছু থাকলে আমি চেক করতে পারি। যেটুক ওনার করা আগেরই করা।
বন কর্মকর্তাকে আর বিব্রত না করে স্যাটেলাইট ছবি ধরে আমরা আরো দ’খলদার খুঁজতে থাকি। বনের সবুজ উজাড় হয়ে যাওয়া জায়গাগুলোর দিকে নজর পড়ে। তার মধ্যে একটি একাশিয়া গাছের বাগান। বনের পাশে কৌশলে বাগান করে জমি দ’খল করেছেন সফেদ মিয়া। তিনি শ্রীমঙ্গল পৌরসভার মেয়র মহসিন মিয়ার চাচাতো ভাই।
বাগানে গিয়ে সফেদ মিয়াকে খুঁজে পাইনি আমরা, দেখা হয় তার ছেলে শাহরাব ইসলামের সাথে। তিনি বাগানটির তদারকি করেন। রিসোর্ট করার জন্য জমি খোঁজার নাম করে তার সাথে কথা বলি। তিনি জানান, এখানে আমার ৮০০ একর জমি আছে। বেশিরভাগ কেনা হলেও বাকিটা যে দ’খলে নিয়েছেন সে কথাও অবলীলায় স্বীকার করে নেন শাহরাব।
এভাবে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জমি দ’খল হচ্ছে প্রতিদিন। নিজেরটা স্বীকার না করলেও বাকি দ’খলদারদের খবর জানেন সং’সদ সদস্য আব্দুস শহীদ। বলেন, কার নাই। সবারই আছে। মেয়রের ভাই আছে, রিসোর্ট করছে না… তুমি গিয়ে থাকলে কোনো ভাড়াও নেবে না, লেমন গার্ডেন আছে। অর্ধেক জায়গা বনের। তুমি যদি এটা রিপোর্ট করতে পারো, রিপোর্ট করো।
এভাবে বন শুধু জমি হারাচ্ছে না, হা’রিয়ে যাচ্ছে জীব-বৈচিত্র্যও। বন ঘিরে যাদের জীবন, বনকে যারা মায়ের মতো ভালোবাসেন, সেই বনে বাস করা আদিবাসীরাও এখন শঙ্কিত।
মৌলভীবাজার বাস করা গারো সম্প্রদা’য়ের সনরিশ মানখিন আফসোস করে বলেন, এই বন না থাকলে কি করবো আমরা। কোথায় যাবো? বনের প্রা’ণীরাই খেতে পায় না আমরা খাবো কী?
পাঁচ দশকেও বন বিভাগ যেমন পারেনি এই বনের দ’খলদার চিহ্নিত করতে, তেমনি কাগজে কলমে পারেনি বনের সীমানা ঠিক করতে। তবে বসে নেই দ’খলদাররা। ফলে রিজার্ভ ফরেস্ট খ্যাত লাউয়াছড়া বন দ’খলদারদের জন্য রিজার্ভ হয়ে যাচ্ছে কিনা সে প্রশ্ন উঠাটাও এখন অবান্তর নয়।
টিআইবি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ফেলোশিপে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
সূত্রঃ যমুনা টিভি