দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা মেস জীবন, টিসিবির লাইনে শিক্ষার্থীরা

| আপডেট :  ২২ মার্চ ২০২২, ০৮:১৫ অপরাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২২ মার্চ ২০২২, ০৮:১৫ অপরাহ্ণ

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা সাধারণ মানুষ। চাল, ডাল, তেল, আটা, চিনি ও পেঁয়াজসহ সব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যেন আকাশছোঁয়া। কম দামে পণ্য কিনতে প্রতিদিন বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ট্রাক সেলের লাইনে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন।দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের সঙ্গে একই লাইনে শামিল হচ্ছেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে রাজধানীতে উচ্চশিক্ষা নিতে আসা বিভিন্ন কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও।

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে শহুরে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের পাশাপাশি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ঢাকায় টিকে থাকাই যেন কঠিন হয়ে পড়েছে। বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই পর্যাপ্ত আবাসন ব্যবস্থা না থাকায়, তারা বাসা অথবা মেস ভাড়া করে থাকেন। এসব শিক্ষার্থীদের কেউ টিউশনি অথবা বিভিন্ন শো-রুম, লাইব্রেরিতে পার্টটাইম জব করে নিজেদের খরচ চালান। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে থেমে নেই তাদের জীবনযাত্রা।

মঙ্গলবার রাজধানীর পুরান ঢাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় কলতাবাজার ও বাহাদুর শাহ পার্ক এলাকায় টিসিবির ট্রাকের পেছনে লম্বা লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছে কয়েকশ নারী-পুরুষ। কারও মুখে মাস্ক আছে, কারও মাস্ক থুতুর নিচে, কারও আবার মাস্ক নেই। কেউ মাথা নিচু করে, কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে।

এখানেই কম টাকায় টিসিবির পণ্য কিনতে লাইনে দাঁড়িয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী উত্তম কুমার। তিনি জানান, ছোট ভাই কলেজিয়েট স্কুলে পড়ে। ওকে নিয়ে আমি একটা রুম ভাড়া করে ঢাকায় থাকি। বাবা কৃষি কাজ করেন। পরিবারের আয় কম। টিউশনি করেই নিজের খরচ চালাই। বাজারে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে খাদ্যপণ্যের দাম। একটু কম দামে পণ্য পাবার আশায় লাইনে দাঁড়িয়েছি।

সোহরাওয়ার্দী কলেজের রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী রুবেল জানান, বাজারে নিত্যপণ্যের লাগামহীন দামের কারণে নিম্ন ও মধ্য আয়ের লোকজন এখন টিসিবির পণ্যের অপেক্ষায় থাকেন। অনেকে আবার লোকলজ্জার কারণে লাইনে দাঁড়াতে না পারলেও অন্য কাউকে লাইনে দাঁড় করিয়ে পণ্য কেনেন। ফলে যেখানে টিসিবির ট্রাক, সেখানেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে মানুষ। বাজারে সয়াবিন তেলের দাম বেশি। এখানে তুলনামূলক একটু কম দামে তেল নিয়েছি। ১১০ টাকা লিটার তেল নিয়েছি। বাজারে এই তেল কিনতে ২০০ টাকা লাগত।

কবি নজরুল সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাকিবুল সজীব জানান, একটা শো-রুমে কাজ করি। সকালে টিউশনি করাই। বাবা নেই। বাড়িতে মা অসুস্থ। বাড়িতেও টাকা পাঠাতে হয়। ঢাকায় নিজের থাকা খাওয়ারও খরচ আছে। টিসিবিতে মসুর ডাল ৬৫ টাকা, পেঁয়াজ ৩০ টাকা, তেল ১১০ টাকায় পাচ্ছি। কিছুটা সাশ্রয় করতেই এই টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়েছি। সরকারের কাছে একটাই দাবি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য যেন কিছুটা হলেও কমানো হয়। নয়তো আমাদের মতো শিক্ষার্থীদের মেসে থাকা আরও কষ্টসাধ্য হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও কবি নজরুল সরকারি কলেজের কয়েকজন নারী শিক্ষার্থী জানান, আমরা ১২ জন একসাথে একটি বাসা ভাড়া করে থাকি। সবার পরিবারের অবস্থা সমান না। দু-একজন ছাড়া সবাই আর্থিক অসচ্ছলতায় আছি। এখানে একটু কম দামে পণ্য পাওয়া যায়। তাই প্রায় দেড় ঘণ্টা প্রচণ্ড রোদে লাইনে দাঁড়িয়েও তেল, ডাল ও পেঁয়াজ নিয়েছি। বাজার থেকে কিনলে এগুলো আরও বেশি দামে কিনতে হতো।

সরকার নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় বাজার স্থিতিশীল রাখতে টিসিবির মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে ডাল, তেল, চিনি, ছোলা বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু সাধারণ ক্রেতাদেরও রয়েছে নানা অভিযোগ। লাইনে দাঁড়িয়েও পণ্য না পাওয়া, তেলের জন্য লাইনে দাঁড়ালে তেল না থাকা, থাকলেও তার সাথে ডাল নিতে বাধ্য করা, একটি পণ্য নিলে সাথে আরেকটি পণ্য নিতে বাধ্য করা, খুচরো টাকা না থাকাসহ নানা ধরনের অসহযোগিতার অভিযোগ করেন ন্যায্য মূল্যে পণ্য কিনতে আসা অনেকে।

বাহাদুর শাহ পার্কে টিসিবির এক পণ্য বিক্রেতা ইদ্রিস আকন্দ বলেন, ট্রাক আনতে না আনতেই অনেক মানুষ লাইনে দাঁড়ায়, আমরা পণ্য দিয়ে সেরে উঠতে পারি না। সময় বাড়তে বাড়তে লাইনও বড় হতে থাকে। পণ্য শেষ হয়ে যায়, কিন্তু লাইন শেষ হয় না। অনেকেই হাজার টাকার নোট নিয়ে আসে। এখন সবাই যদি হাজার, ৫শ টাকার নোট নিয়ে আসে, এত খুচরো আমরা পাই কই। বিশৃঙ্খলা এড়াতে আমাদের একজন লাইন ঠিক রাখে, যাতে একজনের সামনে আরেক জন না আসে। আমরা শান্তিপূর্ণ ভাবে পণ্য দেয়ার চেষ্টা করি।

তিনি বলেন, টিসিবির এই কার্যক্রমে চিনি, মসুর ডাল, সয়াবিন তেল ও পেঁয়াজ বিক্রি হয়। এখানে চিনি প্রতি কেজি ৫৫ টাকা, মসুর ডাল প্রতি কেজি ৬৫ টাকা, সয়াবিন প্রতি লিটার ১১০ টাকা এবং পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৩০ টাকায় বিক্রি হয়। একজন দুই কেজি করে পণ্য এবং দুই লিটার তেল নিতে পারছেন।