দেশে ফের বাড়ছে গ্যাসের দাম

| আপডেট :  ২২ মার্চ ২০২২, ০১:২৮ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২২ মার্চ ২০২২, ০১:২৮ পূর্বাহ্ণ

দেশে ফের গ্যাসের দাম বাড়ছে। এই নিয়ে গণশুনানি শুরু করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। করোনা মহামারির মধ্যে দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের কঠোর সমালোচনার মধ্যেই এই গণশুনানি শুরু করে সংস্থাটি। শুনানিতে বক্তারা বলেছেন, করোনার এই মহামারির মধ্যে নিত্যপণ্যের দাম এমনিতেই আকাশচুম্বী। এরমধ্যে কোম্পানিগুলোর গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব কোনো যৌক্তিকতা নেই বলে তারা মনে করেন। গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন তারা। গতকাল রাজধানীর বিয়াম অডিটরিয়ামে বিইআরসি’র উদ্যোগে আয়োজিত চার দিনব্যাপী গণশুনানির প্রথম দিনে অংশগ্রহণ করে বক্তারা এসব কথা বলেন।

গণশুনানিতে অংশগ্রহণ করে ভূ-তত্ত্ববিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে গণশুনানির প্রয়োজন দেখছি না।দেশে গ্যাস অনুসন্ধান করতে হবে। কেন এলএনজি’র দিকে দৌড়াচ্ছি।

এলএনজি’র ওপর নির্ভর হওয়ার প্রয়োজন নেই। আমরা ভুল পথে হাঁটছি। দেশে গ্যাস শেষ হয়ে যায়নি। বাংলাদেশে মাত্র এক-তৃতীয়াংশে গ্যাস অনুসন্ধান হয়েছে। গ্যাস উৎপাদনের উপর জোর দেন তিনি। বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. নুরুল ইসলাম শুনানিতে অংশগ্রহণ করে বলেন, সিস্টেম লস কমাতে হবে। বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মাহমুদুল ইসলাম বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা নেই। দাম বৃদ্ধির সুযোগ দেখছি না। গ্যাসের সিস্টেম লস কমালে দাম বৃদ্ধির প্রয়োজন হবে না।

গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়ে বর্তমান দাম বহাল রাখার আহ্বান জানিয়েছেন কনজ্যুমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম। সমপ্রতি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্যাসের দাম ১১৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে বিইআরসি’র কাছে প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবের গণশুনানির প্রথমদিন প্রস্তাব বিষয়ে উত্থাপন করে পেট্রোবাংলা। এ সময় ক্যাবের পক্ষ থেকে প্রস্তাবনার মূল্যায়ন ও ভোক্তার পক্ষে তিনি এ সুপারিশ উত্থাপন করেন।

সুপারিশগুলো হলো-(১) গ্যাসের বিদ্যমান মূল্যহার বহাল রেখে সব পর্যায়ের ট্যাক্স-ভ্যাট, অযৌক্তিক (লুণ্ঠনমূলক) ব্যয় কমিয়ে গ্যাসে আর্থিক ঘাটতি কমানোর সুপারিশ। (২) গ্যাস চুরি ও পরিমাপে কারচুপি এবং অস্বাভাবিক ব্যয়ে চাহিদার অতিরিক্ত সম্পদ অর্জনের মাধ্যমে ভোক্তাদের কাছ থেকে অর্থলুণ্ঠন হচ্ছে। তার জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলাসহ গ্যাস সরবরাহে নিয়োজিত সব কোম্পানির নিজ নিজ পরিচালনা বোর্ডকে অভিযুক্ত করা হলো। এ অভিযোগ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মুনাফা মার্জিন রহিত করে ব্রেক-ইভেনে চলার প্রস্তাব করা হয়। (৩) গ্যাস খাতে সুশাসন নিশ্চিতের লক্ষ্যে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য অংশীজনদের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠন করার প্রস্তাব করা হয় ক্যাবের পক্ষ থেকে।

(৪) এর আগে গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিইআরসি’র আদেশাবলি পালন না করার দায়ে এবং গ্যাস খাত বিপর্যস্ত করার জন্য দায়ী সংশ্লিষ্ট লাইসেন্সধারীদের বিরুদ্ধে বিইআরসি আইনের ৪৩ ধারা এবং ৪৬ ধারায় ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তাব করা হলো। (৫) গ্যাস সেবাকে স্বার্থ সংঘাত মুক্ত করার লক্ষ্যে, সেবা দেয়া লাইসেন্সধারীদের পরিচালনা বোর্ডকে আমলা মুক্ত করার প্রস্তাব করা হলো। শুনানিতে সুপারিশ উল্লেখ ও প্রস্তাবনার বিষয়ে মূল্যায়ন ও অসামঞ্জস্যতা তুলে ধরেন ক্যাব উপদেষ্টা। তিনি বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিষয়ে আপত্তি রইলো। ড. শামসুল আলম বলেন, তাদের কাছে যে তথ্য চেয়েছিলাম তার কোনো তথ্যই পাওয়া যায়নি। এমন অবস্থায় গণশুনানিতে অংশ নেয়া কোনো অর্থবহন করে না। তাদের তথ্য না দেয়ার কি মিনিং থাকতে পারে।

মুঠোফোন গ্রাহক সমিতির সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, করোনার মহামারির মধ্যে নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। মানুষ দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। এরমধ্যে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব মানি না। এটা প্রত্যাখ্যান করলাম।

বিইআরসি চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল তার উদ্বোধনী বক্তব্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বিশ্ব প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, বিভিন্ন জিনিসের দাম বৃদ্ধির কারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। বিতরণ কোম্পানিগুলো শিল্প-কারখানায় ১১৭ ভাগ এবং গৃহস্থালিতে ১১৬ ভাগ গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করছে। তবে কমিশন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষেত্রে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেবে। এবার মূল্য নির্ধারণে অবিবেচক হবে না। মূল্যহার সুবিবেচনা, সুনির্দিষ্ট ভারসাম্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত দেয়া হবে।

বাস্তবতার নিরিখে হবে ঘোষণা, কোনো অমানবিক সিদ্ধান্ত দেয়া হবে না। তিনি বলেন, বিইআরসি প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যহার নির্ধারণ করে আসছে। কমিশন হচ্ছে আধা-বিচারিক ব্যবস্থা, এখানে যুক্তি ও প্রমাণের মাধ্যমে মূল্যহার নির্ধারণ করা হয়। আমরা আশা করবো পেট্রোবাংলা তার পরিচ্ছন্ন তথ্য উত্থাপন করবেন। জিডিএফ জনগণের পয়সা দ্বারা গঠিত, এখান থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে সরকার। সে বিষয়ে পেট্রোবাংলার সঠিক ব্যাখ্যা প্রয়োজন।

সিস্টেম লস সাড়ে ৮ শতাংশের উপরে। পৃথিবীর কোথাও ২ শতাংশের বেশি নেই। সিস্টেম লস গ্রহণযোগ্য মাত্রায় হওয়া উচিত। কোনো সংস্থা তার তথ্যের প্রতি দৃঢ় এবং অবিচল নয়। তারা আজকে একটি তথ্য দিলে কয়েকদিন পরে আরেক রকম তথ্য দিচ্ছে। একটি অভিন্ন ডাটা সেন্টার থাকা উচিত বলে মন্তব্য করেন বিইআরসি চেয়ারম্যান।

পেট্রোবাংলার গ্যাসের দাম বৃদ্ধির তথ্যে একমত নন বিইআরসি: পেট্রোবাংলা মিশ্রিত গ্যাসের পাইকারি ব্যয় (২০২২ সালে প্রতি ঘনমিটার) ১৫ দশমিক ৩০ টাকা পড়বে, এ কারণে ২০ দশমিক ৩৫ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে। তবে বিইআরসি কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি মনে করছে এই ব্যয় দাঁড়াবে ১২ দশমিক ৪৭ টাকা। কারিগরি কমিটি মূল্যায়ন রিপোর্টে পেট্রোবাংলাকে অনুদান দেয়ার সুপারিশ করেছে। বিইআরসি’র গণশুনানিতে এমন তথ্য তুলে ধরেন বিইআরসি’র কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির আহ্বায়ক পরিচালক (গ্যাস) দিদারুল আলম।

বিয়াম মিলনায়তনে এই গণশুনানি শুরু হয়েছে। সর্বশেষ গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আদেশে (২০১৯ সালে) পাইকারি দর প্রতি ঘনমিটার ১২ দশমিক ৬০ টাকা করা হয়। এরমধ্যে ইউনিট প্রতি ভর্তুকি দিয়ে ৯ দশমিক ৩৭ টাকায় বিক্রির নির্দেশ দেয় বিইআরসি। পেট্রোবাংলা বলছে চলতি বছরে সরবরাহ ব্যয় দাঁড়াবে ১৫ দশমিক ৩০ টাকা- এ জন্য ভোক্তা পর্যায়ে ২০ দশমিক ৩৫ টাকা করার দাবি করেছে পেট্রোবাংলা। তবে কারিগরি কমিটি পেট্রোবাংলার তথ্যের সঙ্গে একমত হতে পারছেন না।

তারা মনে করছে মিশ্রিত গ্যাসের সরবরাহ ব্যয় দাঁড়াবে ১২ দশমিক ৪৭ টাকা। কারিগরি কমিটি তাদের রিপোর্টে দেখিয়েছেন স্পট মার্কেট থেকে দৈনিক ৯৯ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আমদানি করা হচ্ছে। যা মোট গ্যাসের মধ্যে প্রায় ৩ শতাংশের মতো। বিদায়ী অর্থবছরে গ্যাসের মিশ্রিত ব্যয় ২ দশমিক ৪০ টাকা কমে ১০ দশমিক ১২ টাকায় নেমে এসেছে। আর এটা নিয়েই যত আপত্তি জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের। ভোক্তারা এই মুহূর্তে দাম না বাড়ানোর পক্ষে মতামত দিয়েছে।

বিইআরসি’র কমিশনের চেয়ারম্যান আব্দুল জলিলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শুনানি গ্রহণে উপস্থিত ছিলেন সদস্য মকবুল-ই ইলাহী চৌধুরী, বজলুর রহমান, মোহাম্মদ আবু ফারুক ও মো. কামরুজ্জামান। গণশুনানিতে বিইআরসি, পেট্রোবাংলার বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।