পেনশনের টাকায় ২৩ বছর ধরে অনাথ আশ্রম চালাচ্ছেন নিঃসন্তান দুলাল

| আপডেট :  ১৫ মার্চ ২০২২, ০৯:৫৮ অপরাহ্ণ | প্রকাশিত :  ১৫ মার্চ ২০২২, ০৯:৫৮ অপরাহ্ণ

পেনশনের টাকায় অনাথ আশ্রম খুলে ২৩ বছর ধরে শিশুদের লালন-পালন করছেন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা মো. পিজিরুল আলম দুলাল। নিঃসন্তান এই বৃদ্ধ এখন শত শত অনাথ মেয়েশিশুর অভিভাবক। মা-বাবার আদর দিয়ে এসব শিশুকে আগলে রেখেছেন। শতাধিক শিশুকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি।

পিজিরুল আলম দুলাল নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার বালাগ্রাম ইউনিয়নের চাওড়াডাঙ্গী গ্রামের বাসিন্দা। ১৯৯৬ সালে উত্তরা ব্যাংকের সহকারী জেনারেল ম্যানেজার পদ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। বাবা মৃত মোসলেম উদ্দিন আহমেদ ছিলেন স্কুলশিক্ষক। মা মৃত পিয়ারা আহমেদ ছিলেন সমাজকর্মী।

স্ত্রীর মৃত্যু ও অনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠাঃ ১৯৯৮ সালে দুলালের স্ত্রী মোতাহারা বেগম মারা যান। স্ত্রীকে হারানোর পর একা হয়ে পড়েন। তখন সমাজের অবহেলিত ও অনাথ শিশুদের জন্য কিছু করার স্বপ্ন জাগে। সে অনুযায়ী পাঁচ অনাথ শিশুকে নিয়ে ১৯৯৯ সালে চাওড়াডাঙ্গী গ্রামে পৈতৃক সম্পত্তিতে ‘চাঁদমনি’ নামে অনাথ আশ্রম গড়ে তোলেন। সেখানে বর্তমানে ৩৫ মেয়েশিশু বসবাস করে। এই আশ্রমের ধারণক্ষমতা ৪৫-৫০ জনের। শিশুদের থাকা-খাওয়া ও পড়াশোনার যাবতীয় খরচ জোগান দেন দুলাল।

কেমন আছে চাঁদমনির অনাথ শিশুরাঃ বর্তমানে চাঁদমনি আশ্রমে ৩৫ মেয়েশিশু থাকে। তারা এখানে থেকে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। পাশাপাশি সকাল-সন্ধ্যা দু’বেলা তাদের পড়াশোনা করান দুলাল। একই সঙ্গে যেসব শিশুর বিদ্যালয়ে যাওয়ার বয়স হয়নি তাদেরও হাতেখড়ি দেন। গত ২৩ বছরে আট শতাধিক মেয়েশিশু লেখাপড়া শিখে বিভিন্ন জায়গায় চাকরি করছে। জেলার সবার কাছে চাঁদমনি পরিচিত। এখানে বিনামূল্যে থাকা-খাওয়া ও লেখাপড়া শেখানো হয়।

এসব শিশুর খরচ চালান দুলাল। যাদের বাবা নেই, মা নেই অথবা বাবা-মা ও আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই; এমন শিশুদের শিক্ষিত করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। সপ্তাহে চার দিন আলেম দিয়ে কোরআন শিক্ষা দেওয়া হয়। ছবি আঁকার ক্লাস হয় সপ্তাহে একদিন। মাসে দুদিন গান শেখানো হয়। মেয়েদের হস্তশিল্প ও সেলাই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

আশ্রমে থাকার শর্তঃ পিজিরুল আলম দুলাল বলেন, ‘চাঁদমনি আশ্রমে থাকার প্রথম শর্ত হলো অনাথ এবং মেয়ে হতে হবে। তবে কোনও শিশুর বাবা-মা দুজনের একজন যদি মৃত হন এবং সন্তানের ভরণপোষণ চালাতে অক্ষম হন তাহলে তাকেও আশ্রমে রাখা হয়। পাশাপাশি এখানে থাকার আরও কিছু শর্ত হলো- বাল্যবিয়ে দেওয়া যাবে না, কমপক্ষে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করতে হবে। ধর্মান্ধতা-কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আধুনিক জীবনযাপন করতে হবে। এসব মেনেই এখানে মেয়েশিশুদের রাখা হয়।’

আশ্রমে মেয়েশিশুদের নিরাপত্তাঃ শিশুদের নিরাপত্তার ব্যাপারে পিজিরুল আলম দুলাল বলেন, ‘লেখাপড়ার জন্য নিরিবিলি পরিবেশ রয়েছে। রয়েছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আছে হলরুম ও লাইব্রেরি। নিজ নিজ কক্ষে রয়েছে চেয়ার-টেবিল। ক্লাসের বই পড়া ছাড়াও ছবি আঁকা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ছোট গল্প, উপন্যাস ও গুণীজনদের জীবনী পড়ার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এভাবে ২৩ বছর ধরে চলছে। কখনও কোনও সমস্যা হয়নি।’

অনাথ আশ্রমে থাকা জাকিয়া, পিংকি, ফেরদৌসি, শান্তনা, সোমা, লাভলি, আরিফা, আশামনি, নিশাদ, তানজিলা, দুলালী, পিয়া, হাবিবা, নদী, রুবিনা, রুজিনা, মুনমুন, মঞ্জিলা, মম ও মিতু জানায়, ‘আমাদের বাবা-মা নেই। আমরা এখানে ভালো আছি। আদর-যত্ন করে লালন-পালন করছেন আমাদের বাবা (দুলাল)।’

আশ্রমে থাকা মিম ও মিনির বাবা নেই। তাদের মা হাসিনা বেগম বলেন, ‘স্বামী মারা যাওয়ার পর অভাবের সংসারে তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে চরম কষ্টে দিন যাচ্ছিল। হঠাৎ একদিন এলাকার ডিম বিক্রেতা প্রদীপ কুমারের কাছে জানতে পারি চাঁদমনি নামে একটি অনাথ আশ্রম আছে। তার হাত ধরে দুই মেয়েকে রেখে আসি। এখন মেয়েরা খুব ভালো আছে। লেখাপড়া করছে। আমি প্রাণভরে দুলাল ভাইয়ের জন্য দোয়া করি সবসময়।’

উপজেলার পাঙ্গা মটুকপুর ইউনিয়নের মটুকপুর পূর্বপাড়া গ্রামের মৃত হুজুর আলীর মেয়ে মনিরা আকতার বলেন, ‘২০১২ সাল থেকে সাত বছর আমি চাঁদমনি আশ্রমে ছিলাম। এখন আমি জলঢাকা কলেজে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। বাবা মারা যাওয়ার পর মায়ের হাত ধরে চাঁদমনিতে গেছি। বাবা না থাকলেও কখনও তার অভাব বুঝতে দেননি আমার অভিভাবক দুলাল। আমার মতো শত শত শিশু সেখানে থেকে লেখাপড়া করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমরা সবাই আমাদের অভিভাবকের জন্য দোয়া করি।’

চাঁদমনিতে থেকে পড়াশোনা করে এখন চাকরি করছেন জেসমিন, মোমেনা, রিতা, লিপি ও ফিরোজাসহ আরও কয়েকজন। নিপা বিএসসি পাস করে চাকরি করছেন স্বাস্থ্য বিভাগে। নার্সের চাকরি করছেন মনতেজা বানু ও মফেজা বানু। অন্যদের অনুরোধ থাকায় নাম-পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি।

পিজিরুল আলম দুলাল বলেন, ‘এ পর্যন্ত চাঁদমনি থেকে পড়াশোনা করে এসএসসি পাস করেছে ১৫০ জন। এইচএসসি পাস করেছে ১৫০ জন। বিএ পাস করেছে ছয় জন ও এমএ পাস করেছে চার জন। অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের গড়ে তোলাই আমার কাজ।’

তিনি বলেন, ‘কন্যাশিশুরা প্রাথমিকের সিঁড়ি পেরিয়ে মাধ্যমিকে যাওয়ার আগেই ঝরে পড়ে। অভাব-অনটনের মধ্যে কোনও রকমে শিক্ষিত হলেও ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারে ঢেকে যায় জীবন। সমাজে তাদের প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পেনশনের সব টাকা অনাথ শিশুদের জন্য খরচ করছেন পিজিরুল আলম দুলাল। নিঃসন্তান হওয়ায় পৈতৃক সহায়-সম্পত্তিও ব্যয় করছেন তাদের পেছনে। চাঁদমনির শিশুদের পড়াশোনা ও যাবতীয় খরচ বছরে সাত লাখ টাকা। এই টাকা বন্ধু-বান্ধব, ব্যাংকের সাবেক সহকর্মী, বিদেশে অবস্থানরত আত্মীয়-স্বজন, বোন মাসুদা বেগম, ভগ্নিপতি আব্দুল কাদের সরকার, ডা. শামীম হাসানসহ বিভিন্ন লোকজন সহায়তা দিয়ে থাকেন। করোনার সংকটময় পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানটি আর্থিক সংকটে পড়লেও কাউকে সমস্যার কথা জানাননি দুলাল। শত সমস্যা নিয়ে মানবসেবা চালিয়ে যাচ্ছেন।

নীলফামারী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি প্রকৌশলী এসএম শফিকুল আলম ডাবলু বলেন, ‘সমাজে অনেক বিত্তশালী মানুষ আছেন। যারা এসব কাজে অর্থ ব্যয় করেন না। অথচ বৃদ্ধ বয়সে মা-বাবার দায়িত্ব নিয়ে মেয়ে অনাথ শিশুদের আলোকিত করে তুলছেন দুলাল। এটি মহতী উদ্যোগ। পৃথিবী যতদিন থাকবে তার কাজ ইতিহাস হয়ে থাকবে। তার এই কাজে সবাইকে সহায়তার হাত বাড়ানো উচিত।’

নীলফামারীর জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন বলেন, ‘চাঁদমনির প্রতিষ্ঠাতা পিজিরুল আলম দুলাল প্রগতিশীল মানুষ। দেশের নারী সমাজকে এগিয়ে নিতে তার ভূমিকা উদাহরণ হয়ে থাকবে। এমন মহৎ কাজে প্রত্যেকের এগিয়ে আসা উচিত।’ সুত্রঃ বাংলা ট্রিবিউন