আতঙ্কে মোটরসাইকেল মালিকরা

| আপডেট :  ১৪ মার্চ ২০২২, ০৭:৫৭ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ১৪ মার্চ ২০২২, ০৭:৫৭ পূর্বাহ্ণ

মোটরসাইকেল মালিকদের জন্য আ’তঙ্কের শহরে পরিণত হয়েছে ঢাকা। প্রতিদিনই প্রায় অর্ধশতাধিক মোটরসাইকেল চু’রি হয় ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে। কিন্তু চু’রি হওয়া এসব মোটরসাইকেলের হদিস পাওয়া যায় না। ভু’ক্তভোগীরা অনেক সময় ঝক্কিঝামেলা এড়াতে থানায় মা’মলা করেন না। আর যারা মা’মলা করেন তারা মাসের পর মাস থানা ও গো’য়েন্দা পুলিশের কাছে ধরনা দিয়েও তেমন লাভবান হন না। খুব কম মালিকই চু’রি হওয়া মোটরসাইকেল ফিরে পান। কিন্তু চোরদের দাপট বেড়ে যাওয়াতে আ’তঙ্কে আছেন মালিকরা। সতর্ক থাকার পরও অনেক মালিককে হারাতে হচ্ছে শখের মোটরসাইকেল।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও কিছুদিন পর পর চোর চ’ক্রের সদস্যদের গ্রে’প্তার করে মা’মলা দিয়ে জে’লে পাঠান। কিন্তু চ’ক্রের সদস্যরা জা’মিনে বের হয়ে আবার একই কাজ করে। এতে করে কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না মোটরসাইকেল চু’রির ঘটনা। শুধু মোটরসাইকেল নয় ঢাকা থেকে সিএনজি, প্রাইভেটকার, ট্রাক, পিকআপ, বাসসহ অন্য গাড়ি চু’রির ঘটনা নেহায়েত কম নয়। যেভাবে গাড়ি চু’রির সংখ্যা বাড়ছে সেই হারে উ’দ্ধারের ঘটনা একেবারে কম।

গো’য়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকার মোটরসাইকেল চু’রির সঙ্গে জ’ড়িত আছে পেশাদার অন্তত ১০টি গ্রুপ। এসব গ্রুপে সর্বনিম্ন ৫ জন থেকে শুরু করে ২০ জন আর এর চেয়ে বেশি সদস্য রয়েছেন। সদস্যদের মধ্যে কিছু সদস্য পর্যায়ক্রমেই বিভিন্ন মা’মলায় জে’লে থাকেন। আর বাকিরা প্রতিদিন মোটরসাইকেল চু’রি করে।

গো’য়েন্দাদের কাছে প্রতিদিন কত মোটরসাইকেল বা অন্যান্য যানবাহন চু’রি হয় তার কোনো সঠিক তথ্য নেই। তবে মা’মলার পরিসংখ্যান থেকে ধারণা করছেন প্রতিদিন অন্তত ডজনখানেক মোটরসাইকেল চু’রি হয়। এর বাইরে অন্য গাড়িও আছে। যদি গড়ে প্রতিদিন ১২টা মোটরসাইকেল চু’রি হয় তবে মাসে ৩৬০টি। বছরে সাড়ে চার হাজার মোটরসাইকেল চু’রি হয়। সেই তুলনায় বছরে উ’দ্ধার হয় সর্বোচ্চ ১ মাসে চু’রি হওয়ার সমপরিমাণ বা তার চেয়ে কম মোটরসাইকেল।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তথ্য মতে ২০২০ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোটরসাইকেল উ’দ্ধার করা হয়েছে ১৮২টি। এরমধ্যে জানুয়ারি মাসে ৩৪টি, ফেব্রুয়ারিতে ১৫টি, মার্চে ৩০টি, এপ্রিলে ৪টি, মে মাসে ৩টি, জুনে ৯টি, জুলাইতে ১২টি, আগস্টে ১১টি, সেপ্টেম্বরে ২২টি, অক্টোবরে ২৪টি, নভেম্বরে ১৩টি, ডিসেম্বরে ৫টি।

২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উ’দ্ধার হয়েছে ৪৮টি মোটরসাইকেল। এরমধ্যে জানুয়ারিতে ৫টি, ফেব্রুয়ারিতে ৭টি, মার্চে ৭টি, এপ্রিলে ৬টি, মে মাসে ৫টি, জুনে ৩টি, জুলাইতে ৪টি, আগস্টে ৫টি ও সেপ্টেম্বরে ৬টি মোটরসাইকেল উ’দ্ধার করা হয়েছে। সবমিলিয়ে ২১ মাসে উ’দ্ধার করা হয়েছে মাত্র ২৩০টি মোটরসাইকেল।

ডিএমডি সূত্রে আরও জানা যায়, ২০২০ সালে ঢাকার বিভিন্ন থানায় সব ধরনের গাড়ি চু’রির মা’মলা হয়েছে ৩৩২টি। গ্রে’প্তার করা হয়েছে ১৬২ জনকে। উ’দ্ধার করা হয়েছে ৩৯৮টি চোরাই গাড়ি। এসব গাড়ির মধ্যে বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার, জিপ, পিকআপ, সিএনজি, মোটরসাইকেল রয়েছে।

২০২০ সালের জানুয়ারিতে গাড়ি চু’রির মা’মলা হয়েছে ৩৭টি, গ্রে’প্তার করা হয়েছে ৯ জনকে। ফেব্রুয়ারিতে মা’মলা ৩০টি, গ্রে’প্তার ১৮ জন। মার্চে মা’মলা ৩৭টি, গ্রে’প্তার ২৫ জন, এপ্রিলে মা’মলা ৪টি হলেও কোনো গ্রে’প্তার নাই। মে মাসেও ৭টি মা’মলা হলেও কোনো গ্রে’প্তার নাই। জুন মাসে মা’মলা ২৯, গ্রে’প্তার ১৫। জুলাইতে মা’মলা ২৩টি গ্রে’প্তার ১৩, আগস্টে মা’মলা ৩০ গ্রে’প্তার ১৩। সেপ্টেম্বরে মা’মলা ৪৯, গ্রে’প্তার ১৫। অক্টোবরে মা’মলা ৩৫টি গ্রে’প্তার ১৩, নভেম্বরে মা’মলা ২৯টি, গ্রে’প্তার ২৮। ডিসেম্বরে মা’মলা ২২, গ্রে’প্তার ১৩।
ওই বছর জানুয়ারিতে উ’দ্ধার করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের ৫২টি গাড়ি। ফেব্রুয়ারিতে ৩৭টি, মার্চে ৫৮টি, এপ্রিলে ৯টি, মে মাসে ৪টি, জুনে ২৯টি, জুলাইতে ৩৩টি, আগস্টে ৩২টি, সেপ্টেম্বরে ৫৩টি, অক্টোবরে ৫০টি, নভেম্বরে ২৫টি ও ডিসেম্বরে ১৬টি।

২০২১ সালে ঢাকার বিভিন্ন থানায় গাড়ি চু’রির মা’মলা হয়েছে ২৫৮টি, গ্রে’প্তার করা হয়েছে ১০০ জন আ’সামিকে। এরমধ্যে জানুয়ারিতে মা’মলা হয়েছে ২৯টি, গ্রে’প্তার ১৫ জন। ফেব্রুয়ারিতে মা’মলা ৩২টি, গ্রে’প্তার ১৪ জন। মার্চে মা’মলা ২২টি, গ্রে’প্তার ৫ জন। এপ্রিলে মা’মলা ৩২টি, গ্রে’প্তার ৯ জন। মে মাসে মা’মলা ৩২টি, গ্রে’প্তার ৬ জন। জুনে মা’মলা ৩৩টি, গ্রে’প্তার ৬ জন। জুলাইতে মা’মলা ২১টি, গ্রে’প্তার ৭ জন। আগস্টে মা’মলা ৩৩টি, গ্রে’প্তার ২০ জন। সেপ্টেম্বরে মা’মলা ২৪টি, গ্রে’প্তার ১৮ জন।

ওই বছর বিভিন্ন ধরনের মোট ৯৮টি গাড়ি উ’দ্ধার করা হয়। এরমধ্যে জানুয়ারিতে উ’দ্ধার করা হয়েছে ১২টি, ফেব্রুয়ারিতে ১৪টি, মার্চে ৯টি, এপ্রিলে ৮টি, মে মাসে ৮টি, জুনে ৭টি, জুলাইতে ১৩টি, আগস্টে ১১টি, সেপ্টেম্বরে ১৬টি।

গো’য়েন্দা ও পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, মোটরসাইকেল চোর চ’ক্রের সদস্যরা ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জনবহুল এলাকা থেকে চু’রি করে। ফিল্মি কায়দায় কয়েক সেকেন্ডের ভেতরে চু’রি করে ওই এলাকা থেকে পা’লিয়ে চ’ক্রের মূলহোতার কাছে পৌঁছে দেয়। মূলহোতা এসব মোটরসাইকেলে নতুন ভুয়া নম্বর প্লেট লাগিয়ে ঘষামাজা করে ইঞ্জিন-চেচিস নম্বর পরিবর্তন করে গ্রামাঞ্জলের ক্রেতার কাছে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেয়। বিক্রি করা এসব মোটরসাইকেলের বাজারমূল্য দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার উপরেও থাকে।

জাকির আহমেদ নামের এক ভু’ক্তভোগী বলেন, আমি একটি বেস’রকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। গত বছরের শেষের দিকে এপাছি ফোরভি নামের একটি মোটরসাইকেল নিয়ে আমি ধানমণ্ডির এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাই। মোটরসাইকেলটির বাজারমূল্য ২ লাখ টাকার ও’পরে ছিল। বাসার নিচে গাড়িটি লক দিয়ে রেখে যাই। ঘণ্টাখানেক পরে এসে আর মোটরসাইকেলটি পাইনি। বিভিন্ন স্থানে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সন্ধান পাইনি। তিনি বলেন, এরপর একই মডেলের আরেকটি বাইক নিয়েছি। এখন খুব সতর্কভাবে থাকি। কাছের অনেকের বাইক সাম্প্রতিক সময়ে চু’রি হয়েছে।

বৃহস্পতিবার ডিএমপি’র মিরপুর ডিভিশনের শাহআলী থানা পুলিশ লিটন দেওয়ান নামের একজনকে গ্রে’প্তার করেছে। লিটন চোরাই মোটরসাইকেল কেনা-বেচার মাস্টারমাইন্ড। যার চ’ক্রে রয়েছে শতাধিক সদস্য। তার সদস্যরা ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় দাপিয়ে বেড়ায়। চু’রি করা মোটরসাইকেল লিটনের কাছে বিক্রি হতো ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকায়। পরে এসব মোটরসাইকেল ঘষামাজা করে ভুয়া নম্বর প্লেট, চেসিস ও ইঞ্জিন নম্বর পরিবর্তন করে বেশি দামে বিক্রি করতেন।

শাহ আলী থানার অফিসার ই’নচার্জ আবুল বাসার মুহাম্ম’দ আসাদুজ্জামান বলেন, রিয়েল বাইক হাউজ নামক একটি পুরাতন মোটরসাইকেলের দোকানের ভেতরে চোরাই মোটরসাইকেল ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য কয়েকজন অবস্থান করছে। এমন সংবাদের ভিত্তিতে আমরা অ’ভিযান পরিচালনা করি। পুলিশের উপস্থিতি বুঝতে পেরে পালানোর চেষ্টা করলে তাদেরকে গ্রে’প্তার করা হয়। এ সময় তাদের হেফাজত থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ৩টি চোরাই মোটরসাইকেল উ’দ্ধার করা হয়। তিনি আরও বলেন, গ্রে’প্তারকৃতরা চোরাই মোটরসাইকেল ক্রয়-বিক্রয় চ’ক্রের সক্রিয় সদস্য।

গত ৬ই জানুয়ারি মোটরসাইকেল চোর চ’ক্রের মূলহোতাসহ তিন সক্রিয় সদস্যকে গ্রে’প্তারের পর চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে ঢাকা মহানগর গো’য়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগের সংঘবদ্ধ অ’পরাধ ও গাড়ি চু’রি প্রতিরোধ দল। গ্রে’প্তারকৃতরা হলো- মশিউর রহমান মিশু (৩২), রনি দালাল (৩১) ও নাজিম শেখ (৩৫)। তাদের কাছ থেকে ১০টি দামি চোরাই মোটরসাইকেল উ’দ্ধার করা হয়। চ’ক্রের সদস্যরা আগেও গ্রে’প্তার হয়েছিল।

ডি’বি গুলশান বিভাগের সহকারী কমিশনার মোহাম্ম’দ খলিলুর রহমান বলেন, চ’ক্রটির টার্গেট দামি মোটরসাইকেল। অভিজাত এলাকা থেকে তারা চু’রি করে। মুন্সীগঞ্জ থেকে মাস্টার চাবি নিয়ে তারা ঢাকায় আসে। একটি মোটরসাইকেল চু’রি করতে চ’ক্রের দু’জন স্পটে থাকে। একজন মালিকের গতিবিধিতে দৃষ্টি রাখে। অন্যজন দ্রুত মোটরসাইকেল নিয়ে পা’লিয়ে যায়। তারপর কয়েক সেকেন্ডের ভেতরে চু’রি করে পা’লিয়ে যায়। চ’ক্রটি গত তিন বছরে অন্তত ৫০০টি মোটরসাইকেল চু’রি করেছে। মানবজমিন