সব
কি’শোরগঞ্জের হাওর এলাকার কারও মৃ’ত্যুর খবর পেলেই তড়িঘড়ি করে খু’ন্তি-কোদাল, দা, চাকু, স্কেল আর করাতসহ কবর খোঁড়ার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে ওই ব্যক্তির বাড়িতে ছুটে যান। দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে ঘোড়ার পিঠে চে’পে যান ৭০ বছর বয়সী মনু মিয়া।মৃ’ত ব্যক্তির বাড়িতে গিয়ে বাঁশ কা’টা থেকে শুরু করে কবর খোঁড়া শেষ করে দাফন পর্যন্ত সেখানে থাকেন। দাফন শেষ হওয়ার পর আবার সব যন্ত্রপাতি ব্যাগে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে উঠে বাড়ির পথে রওনা হন।
কবর খোঁড়ার পর মৃ’ত ব্যক্তির পরিবারের কারও কাছ থেকে নেন না পারিশ্র’মিক বা যাতায়াত খরচ। এমনকি খাবারের বেলায়ও একই নিয়ম তার। নিজের বাড়ি থেকে খেয়ে রওনা না হতে পারলে মৃ’ত ব্যক্তির বাড়িতে গিয়েও খান নিজ খরচে।মনু মিয়ার বাড়ি কি’শোরগঞ্জের ইটনা উপজে’লার জয়সিদ্দি ইউনিয়নের আলগাপাড়া গ্রামে। কবর খোঁড়ার কাজ শুরু করছেন ১৯৭২ সাল থেকে।
মনু মিয়া জানিয়েছেন, তিনি এ পর্যন্ত ২ হাজার ৮৪৭টি কবর খুঁড়েছেন। কি’শোরগঞ্জের বিভিন্ন উপজে’লাসহ হবিগঞ্জ জে’লার আজমিরীগঞ্জ উপজে’লাতেও বহু কবর খনন করেছেন। কবর খোঁড়ার একজন নিখুঁত, সুদক্ষ এবং সুনিপুণ কারিগর হিসেবে নিজের জে’লাসহ পাশের জে’লা হবিগঞ্জেও সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে মনু মিয়ার।
এলাকাবাসী রায়হান উদ্দিন বলেন, মনু ভাই এলাকায় শেষ ঠিকানার কারিগর হিসেবে পরিচিত। কেউ একজন মা’রা গেলে যেকোনো মাধ্যমে খবরটা তার কাছে পৌঁছালেই তিনি ছুটে যান। যেকোনো সময় তাকে দ্রুতগতিতে ছুটে যেতে দেখলেই আমরা বুঝে নিই নিশ্চয়ই কেউ মা’রা গেছেন।
তিনি বলেন, চাহিদাবিহীন এই মানুষটার নাই কোনো স’ন্তান-সন্ততি। নাই অঢেল সম্পদ। তবে তার নীতি-নৈতিকতা আমাদের মুগ্ধ করে। এই বুড়ো বয়সেও কোনো কিছুর বিনিময় ছাড়া সারাটা দিন উনি যে পরিশ্রম করেন সেটা যেকোনো যুবক করলেও হাঁপিয়ে উঠব।
জয়সিদ্দি গ্রামের রশিদ মান্নান বলেন, নিজের পরিবারের কেউ মা’রা গেলে আমরা যেভাবে দায়িত্ব নিয়ে দাফন-কাফনের কাজটা করি, মনু ভাই সে কাজটা সবার জন্যই করেন। কবর খননের জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার সবকিছুই দুই সেট করে তৈরি করেছেন তিনি। যেখানেই যান সঙ্গে এক সেট নিয়ে যান আর আরেক সেট রেখে যান বাড়িতে।
মনু মিয়ার স্ত্রী রহিমা বেগম বলেন, বিয়ের পর প্রথমে উনি যখন এই কাজে যেতেন তখন খুব একটা ভালো লাগত না। এ জন্য নিষেধও করেছি বেশ কয়েকবার। আমার নিষেধ উনি শোনেননি। সকালে কার কবর খুঁড়বেন- এই চিন্তা নিয়ে ঘুমান। রাতভর তার ভালো ঘুম হয় না। সারারাত অপেক্ষায় থাকেন কখন সকাল হবে।
রহিমা বলেন, একপর্যায়ে তার দেখাদেখি আমিও মৃ’ত ব্যক্তির গোসল করানো শুরু করে দিই। ওনার মতো আমি তো গ্রামের বাইরে যেতে পারি না। তবে গ্রামের ভেতরে কোনো মহিলা মা’রা গেলে আমি গিয়ে গোসল করাই।মনু মিয়া বলেন, ১৯৭২ সালে আমার মা মা’রা যান। তখন দেখলাম গ্রামের লোকজন খুবই দায়িত্ব নিয়ে আমার মায়ের কবরটা খুঁড়তেছে। এই জিনিসটা দেখে আমিও তাদের সঙ্গে কাজে নেমে যাই। সেই তখন থেকেই শুরু।
মনু মিয়ার জীবনে আক্ষেপ বাবার মৃ’ত্যুর সংবাদ পেয়েছিলেন ১৫ দিন পর।তিনি বলেন, আমার জীবনে সবচেয়ে বড় আক্ষেপ একটাই, সেটা হলো আমার বাবার মৃ’ত্যুর খবর আমি ১৫ দিন পরে পেয়েছি। কবরও খুঁড়তে পারিনি।
মনু মিয়া বলেন, তখন আমি ঢাকা শহরের নূরেরচালা এলাকায় আমার ভায়রার বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। আর সেই বাসাও কেউ চিনত না। এ ছাড়া তখন কারও মোবাইল ছিল না। ঢাকায় গিয়ে আমি ২০ দিন ছিলাম। বাড়ি থেকে যাওয়ার পাঁচ দিন পরই বাবা মা’রা যান। আর সেই খবর আমি পেয়েছি মৃ’ত্যুর ১৫ দিন পরে।
গ্রামের অন্য যারা কবর খুঁড়তেন প্রথম প্রথম তাদের সহযোগিতা করতেন মনু মিয়া। পরে দেখলেন তার নিজের কাজও বেশ সুন্দর হয়। এ ছাড়া অন্যরাও তার কবর খোঁড়ার প্রশংসা করতেন। এরপর থেকে এই কাজে আগ্রহ বাড়তে থাকে মনু মিয়ার।
তিনি বলেন, একটা মানুষ সবকিছু ফে’লে দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার পর যখন আর কিছুই থাকে না, তখন তার শেষ ঠিকানাটা একটু সুন্দর হোক- এটাই আমি সব সময় চাই। এ পর্যন্ত যতজনকে কবর দিয়েছেন তার বিবরণ অন্যদের দিয়ে ডায়েরিতে লিখে রেখেছেন মনু মিয়া।ডায়েরির তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের ৩ মার্চ পর্যন্ত ২ হাজার ৮৪৭টি কবর খুঁড়েছি।
মনু মিয়ার ভাতিজা নিকলু মিয়া বলেন, মৃ’ত ব্যক্তির বাড়ি থেকে ফিরেই তিনি সর্বপ্রথম গোসলটা সেরে নেন। তারপর খাওয়া-দাওয়া না করে আগে দেখবেন লিখতে পারে এমন কেউ আশপাশে আছে কি না। এরপর যাকে পাবেন তাকে দিয়েই ছোট টুকরা কাগজের লেখাটা তুলবেন মূল ডায়েরিতে।
তিনি বলেন, মৃ’ত ব্যক্তির নাম-ঠিকানা আর মৃ’ত্যুর তারিখ লেখানোর পর খেতে বসবেন তিনি। এমন মানুষ আছে যারা নিজেদের পরিবারের সদস্যদের মৃ’ত্যুর তারিখ ভু’লে গেছেন। তারাও অনেক সময় আসেন তারিখ নিতে। কোথাও কেউ মা’রা গেলেই ফোন চলে আসে। কাজ না থাকলে গ্রামের বাজারে বসে সময় পার করি। অনেক সময় ফোন আসা ছাড়াও লোকমুখে শুনেও রওনা দিই।
মনু মিয়া জানান, বাবার রেখে যাওয়া কিছু সম্পত্তি বিক্রি করে একটি ঘোড়া কিনেছেন। ওই ঘোড়ার পিঠে চড়েই কাঁধে ব্যাগ নিয়ে প্রত্যন্ত হাওর অঞ্চলের এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ছুটে চলেন তিনি। তবে শহর অঞ্চলে গেলে ঘোড়া বাড়িতে রেখে যান। সূত্র: আরটিভি নিউজ