‘ইউক্রেনে থাকলে বোমায়, দেশে ফিরলে না খেয়ে মরবো’

| আপডেট :  ৫ মার্চ ২০২২, ১০:৪৫ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ৫ মার্চ ২০২২, ১০:৪৫ পূর্বাহ্ণ

দু’চোখ ভর্তি স্বপ্ন নিয়ে দুই মাস আগে বাংলাদেশ থেকে ইউক্রেনে যান মো. মনির। রাজধানীর একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ৪ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষে পাড়ি জমান ইউক্রেনে। পরিবারের ১২ সদস্যের মুখে হাসি ফোটাতে গিয়ে এখন জীবন-মৃত্যুর মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে মনির। কাজ হারিয়ে জীবন বাঁচাতে যুদ্ধপীড়িত ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ শহরের একটি

হোস্টেলে অবস্থান করছেন এই বাংলাদেশি প্রবাসী। হোস্টেলের পাশেই একটু পরপর গোলা-বারুদ আর বোমার শব্দ। জীবন বাজি রেখে পড়ে আছেন কিয়েভে। আশা একদিন হয়তো যুদ্ধ থামবে। আবার আগের মতো স্বাভাবিক হবে সবকিছু।পরিচিতি একাধিক শিক্ষার্থী অন্যত্র চলে গেলেও যাননি মনির। মানবজমিনের সঙ্গে বিস্তারিত কথা হয় মনিরের।

গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা। স্ত্রী, মা-বাবা, ভাই-বোন মিলিয়ে প্রায় ১২ জন সদস্যের সংসার। বলতে গেলে বর্তমানে তাদের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি। কিয়েভ শহরে কম্পিউটার গ্রাফিকসসহ সফটওয়ারের কাজ করতেন। বেতন মন্দ ছিল না। নিজের থাকা-খাওয়া এবং গ্রামের বাবা-মাকে নিয়ে ভালোই চলছিল। হঠাৎ করে যুদ্ধ শুরু হলো। শুরুর দিকে মনে হচ্ছিল হয়তো হবে হবে করলেও যুদ্ধ হবে না।

কিন্তু এখন চারপাশে শুধু গোলা-বারুদের শব্দ। ঝাঁজালো গন্ধ। মনির বলেন, যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করতাম প্রত্যেকেই জীবন বাঁচাতে সেখান থেকে নিরাপদ দূরত্বে চলে গেছেন। প্রতিষ্ঠানের মালিক পালিয়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। যাওয়ার আগে আমাকে ট্রেনের টিকেট কেটে দিতে চেয়েছিলেন।

যেন প্রতিবেশী দেশ পোল্যান্ড অথবা অন্য কোথাও চলে যাই। কিন্তু আমি রাজি হইনি। ভেবে নিয়েছি যা আছে ভাগ্যে। সঙ্গে টাকা পয়সা তেমন নেই। যে হোস্টেলে অবস্থান করছি সেখানে নিজেই রান্না করে খাই। হয়তো আর ১৫ থেকে ২০ দিন চলতে পারবো। এরপর আসলে কী হবে জানি না। হোস্টেলটিতে কাজাখস্তান, নাইজেরিয়ানসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিক রয়েছে। তারা প্রত্যেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আছেন এখানে।

সবসময় একটি অজানা শঙ্কা কাজ করছে মনের ভেতর। এই বুঝি কিছু হয়ে যায়। কিয়েভ শহরের কেন্দ্রবিন্দুতেই অবস্থান করছি বলা চলে। এখানে একটি রেলস্টেশন আছে। হাজার হাজার মানুষ সেখানে অবস্থান করছে। বর্তমানে ইউক্রেনে তাপমাত্রা মাইনাস ফাইভ ডিগ্রি। এই ঠাণ্ডার মধ্যেও রেলস্টেশনে, পোল্যান্ড সীমান্তসহ বিভিন্ন স্থানে প্রাণ বাঁচাতে হাজার হাজার মানুষ অবস্থান করছে।

গত সপ্তাহে আমার খুব কাছের একাধিক বাংলাদেশি বন্ধু পোল্যান্ড সীমান্তে এত ঠাণ্ডার মধ্যে প্রায় ৩ দিন অপেক্ষার পরে দেশে ফিরেছে। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত আমাদের এখানে বড় কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি। দেশ থেকে প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ভিডিও ফোনে কথা বলি। তাদের মনোবল ঠিক রাখার চেষ্টা করি। প্রত্যেকেই আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন পার করছেন। বাবা-মায়ের বয়স হয়েছে। ভাইয়ের একটি কসমেটিকসের দোকান আছে। সেটা দিয়ে সামান্য কিছু আয় হয়। কিন্তু তা দিয়ে ভালোভাবে সংসার চলে না।

ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরের জলসীমায় আটকে থাকা বাংলাদেশি জাহাজে ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’ গোলার আঘাতে প্রকৌশলী হাদিসুর রহমানের মৃত্যুর বিষয়ে আক্ষেপ করেন এই প্রবাসী বাংলাদেশি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) ওই জাহাজের থার্ড ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন তিনি। একজন হাদিসুরকে ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করতে তার পরিবারকে আর্থিকভাবে অনেক ত্যাগ শিকার করতে হয়েছে। কতো স্বপ্ন ছিল তাকে নিয়ে পরিবারের। অথচ আজকে তিনি নিথর। একটি গোলার আঘাতে সব শেষ।

আক্ষেপ করে বলেন, আমাদের জীবনের কোনো মূল্য নেই। দেশে আমাদের কর্মস্থানের সুযোগ থাকলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এখানে থাকতে হতো না। এত কিছুর পরেও স্বপ্ন দেখি হয়তো যুদ্ধ শেষ হবে একদিন। আগের মতো আবার পুনরায় স্বাভাবিক হবে সবকিছু। শহরে ফিরবে প্রাণ। স্বাভাবিক হবে জন জীবন। নতুন করে কাজ নেবো। বেঁচে থাকার লড়াই মনে হয় এটাকে বলে।