র‍্যাবের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার নেপথ্যে

| আপডেট :  ২৩ জানুয়ারি ২০২২, ০৩:০৩ অপরাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২৩ জানুয়ারি ২০২২, ০৩:০৩ অপরাহ্ণ

৩ মার্চ ২০২১, মা’র্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রে’সিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র ৪২ দিনের মাথায় অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলপত্র প্রকাশ করেন জো বাইডেন। ১৯৮৬ সালের গোল্ডম্যান-নিকোলস আইন অনুযায়ী, দেশটির প্রত্যেক প্রে’সিডেন্টকেই নিজস্ব নিরাপত্তা কৌশলপত্র প্রকাশ করতে হয়। বাইডেনও তার ব্যতিক্রম নন। ২৮ পৃষ্ঠার এই কৌশলপত্রের বেশিরভাগই মা’র্কিন পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতির চর্বিত চর্বণ হলেও একটি বিশেষ নীতির ক্ষেত্রে পূর্বসূরি তিনজন প্রে’সিডেন্টের থেকে উল্টো পথে হেঁটেছেন বাইডেন।

২০০১ সালের ৯/১১ ঘটনার পর থেকে জর্জ ডব্লিউ বুশ, বারাক ওবামা এবং ডোনাল্ড ট্রা’ম্পের পররাষ্ট্রনীতি এবং নিরাপত্তা ভাবনার প্রায় সিংহভাগ জুড়ে স’ন্ত্রাসবাদ বি’রোধী যু’দ্ধের ছায়া থাকলেও বাইডেনের নিরাপত্তা কৌশলপত্রের কোথাও এর ছিটেফোঁটা উল্লেখও ছিল না।

নিজ প্রশাসনের নিরাপত্তা অগ্রাধিকারের তালিকায় বাইডেন যা যা এনেছেন, তা মোটাদাগে এই, ক) চীনের সঙ্গে সামনের স্নায়ুযু’দ্ধ পরিস্থিতি মো’কাবিলা করা, খ) মা’র্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তির উৎসমুখ, যেমন- গণতন্ত্র, অর্থনীতি ইত্যাদি আরও শক্তিশালী করে তোলা, গ) উদার ও নিয়মতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা গণতন্ত্র এবং মা’নবাধিকারের মতো মূল্যবোধজনিত ইস্যুগুলোতে দেশটির নেতৃত্ব স্থানীয় অবস্থান পুনরুদ্ধার।

স’ন্ত্রাস বি’রোধী যু’দ্ধের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের এই ভোলবদলের কারণ খুঁজতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। ২০১৭ সালের পর থেকে ইসলামিক স্টেট বা আইএসের বি’রুদ্ধে বড় ধরনের সা’মরিক জয় পেয়েছে মা’র্কিন নেতৃত্বাধীন জোট। সিরিয়া এবং ইরাক জুড়ে যে কথিত খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল স’ন্ত্রাসী গোষ্ঠীটি, তাও ভে’ঙে পড়েছে তাসের ঘরের মতো।

সা’মরিক অ’ভিযান, দুর্বল নেতৃত্ব, অন্তর্কোন্দল ও অন্যান্য সং’কটে আল-কায়েদাও রয়েছে ভগ্নদশায়। অন্যদিকে প্রে’সিডেন্ট শি জিনপিং-এর নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ক্রমশই আগ্রাসী হয়ে উঠছে চীন। বিশেষ করে সদ্য সাবেক মা’র্কিন প্রে’সিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রা’ম্পের সময় থেকেই দুই দেশের মধ্যে প্রতিদ্ব’ন্দ্বিতা চ’রমে পৌঁছেছে।

অর্থনৈতিক, সা’মরিক এবং প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টায় চীনা প্রতাপের মুখে নিজের বিশ্ব মোড়লের আসনটি টিকিয়ে রাখতে বেগ পেতে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে। প্রতিরক্ষা, অর্থনীতি এবং কূটনীতি – এই তিন শিবিরে মা’র্কিন সামর্থ্যের পুরোটাই বাইডেন চীনকে ঠে’কাতে বিনিয়োগ করবেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

বাইডেনের অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলপত্র প্রকাশের প্রায় ছয় মাসের মাথায় দুই দশক ধরে আফগানিস্তানে চা’লানো অর্থহীন যু’দ্ধের ইতি টানে হোয়াইট হাউস। ৩০ আগস্ট ২০২১ তারিখ সর্বশেষ মা’র্কিন সে’নাটি প্রত্যাহারের আরও দুই সপ্তাহ আগেই তালেবানের হাতে কাবুলের পতন হয়।

তালেবান নিয়ন্ত্রণাধীন আফগানিস্তান আবার নতুন করে স’ন্ত্রাসের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হতে পারে, এমন আ’শঙ্কা প্রকাশ করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তবে আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে শত তোলপাড় সত্ত্বেও নিজ নীতিতে অটল বাইডেন। অথচ দেশটিতে আইএস খোরাসান (আইএস-কে) জ’ঙ্গিগোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান তৎপরতা এরই মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মাথাব্য’থার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তাই বলা যায়, ভূ-রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষই স’ন্ত্রাসবাদ ইস্যুকে যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকারের তালিকা থেকে সরিয়ে দিয়েছে। আর সম্প্রতি বাংলাদেশের স’ন্ত্রাস বি’রোধী এলিট প্যারামিলিটারি বাহিনী র‍্যাপিড অ্যা’কশন ব্যা’টালিয়ন (র‍্যা’ব)-এর ও’পর যে নি’ষেধাজ্ঞা দিয়েছে মা’র্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তা পুরোপুরি বুঝে উঠতে দেশটির এই নতুন অবস্থান বিবেচনায় না নিয়ে উপায় নেই।স’ন্ত্রাসবাদ মো’কাবিলার মতো একটি ইস্যু বাদ দিয়ে নিরাপত্তা কৌশলপত্র প্রকাশ করার মাস কয়েকের মাথায় র‍্যা’বের ও’পর নি’ষেধাজ্ঞা আসাটা কি নেহাতই কাকতালীয় ঘটনা?

চলতি শতাব্দীর একদম সূচনালগ্নেই একের পর এক জ’ঙ্গি অপতৎপরতার সাক্ষী হতে থাকে দেশ। এমন নৃ’শংস উন্মাদনার সঙ্গে এর আগে চাক্ষুষ পরিচয় হয়নি বাংলাদেশের। ২০০১ সালের রমনা বটমূলে নববর্ষ বরণ অনুষ্ঠানে হা’মলা, ২০০২ সালের ময়মনসিংহে সিনেমা হলে হা’মলা, ২০০৩ সালে নারায়ণগঞ্জ জে’লায় হা’মলার মতো ঘটনার প্রেক্ষাপটেই ২০০৪ সালের ১৪ এপ্রিল যাত্রা শুরু করে র‍্যা’ব। এরপর থেকে র‍্যা’বের পরিসর যতটা বেড়েছে, বাংলাদেশের স’ন্ত্রাসবাদ বি’রোধী সক্ষমতাও ততটাই বেড়েছে এবং সাথে সাথে র‍্যা’বকে কেন্দ্র করে বিতর্কও বেড়েছে সমানতালে। তবে মা’নবাধিকার ল’ঙ্ঘনের অ’ভিযোগ তুলে বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্ন সময়ে উ’দ্বেগ প্রকাশ করলেও দেশে ক্রমশ অ’বনতির দিকে যেতে থাকা নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখায় জনসমর্থনের ঘাটতি হয়নি কখনো এই বাহিনীর।

২০১০ সালে ইউকেভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সেফারওয়ার্ল্ড এক জনউপলব্ধি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, ৯৮ শতাংশ উত্তরদাতা বলেন, র‍্যা’ব সৃষ্টির ফলে অ’পরাধ ও স’ন্ত্রাস দ’মনে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছে। শতকরা ৯৩ ভাগ উত্তরদাতা বাহিনীর প্রতি আস্থা রয়েছে বলে জানান। এমনকি উইকিলিকসের ফাঁ’স করা মা’র্কিন গো’পন কূটনৈতিক নথিতেও দেখা যায়, বিতর্ক সত্ত্বেও র‍্যা’বের জনপ্রিয়তাকে স্বীকার করে নিচ্ছে ওয়াশিংটন—

‘স্থানীয় সুশীল সমাজ ও এনজিও সূত্র থেকে জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে সফল হওয়ায় দেশটির জনগণের শ্রদ্ধা ও প্রশংসার পাত্রে পরিণত হয়েছে র‍্যা’ব।’

র‍্যা’বকে ঘিরে শত অ’ভিযোগ সত্ত্বেও এই বাহিনীর সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠভাবেই কাজ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মাত্র চার বছরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় নজরদারি, ফরেনসিক, মা’দক শনাক্তকরণসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য র‍্যা’বের কাছে অন্তত ১১টি অত্যাধুনিক যন্ত্র বিক্রি করেছে আমেরিকা।

এই সময়ে অন্তত ২২জন র‍্যা’ব সদস্য প্রশিক্ষণ নেওয়ার উদ্দেশে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছে। র‍্যা’বের এয়ার উইং-এর যাত্রাও শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা দুটি বেল-৪০৭ মডেলের হেলিকপ্টার দিয়ে। কেবল যুক্তরাষ্ট্রই নয়, ওয়াশিংটনের মিত্র যুক্তরাজ্যও বেশ কয়েকদফায় র‍্যা’ব সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে।

সিআইএ এবং আমেরিকার ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি (এনএসএ)-এর সহায়তায় নিউজিল্যান্ডের একটি সংস্থার সঙ্গে বছরের পর বছর গো’য়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানও হয়েছে র‍্যা’বের। ২০১২ সালে আমেরিকার ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের উদ্যোগে র‍্যা’বের অভ্যন্তরীণ ত’দন্ত সেল (আইইসি) যাত্রা শুরু করে।

তবে কি স’ন্ত্রাসবাদ ইস্যুর গুরুত্ব ফুরাতেই ওয়াশিংটনের কাছে প্রাসঙ্গিকতা হা’রিয়েছে র‍্যা’ব? আবার স’ন্ত্রাসবাদ বি’রোধী যু’দ্ধের একসময়কার নির্ভরযোগ্য সঙ্গী র‍্যা’বের ও’পর নি’ষেধাজ্ঞা চা’পিয়েই কি ‘গণতন্ত্র ও মা’নবাধিকার’-এর ধ্বজা ওড়াতে চায় বাইডেন প্রশাসন?

ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের হিসাব-নিকাশ আমেরিকার কাছে স’ন্ত্রাসবাদ বি’রোধী তৎপরতার গুরুত্ব কমিয়ে দিতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর কাছে স’ন্ত্রাসবাদের হু’মকি এখনো জীবন্ত।

২০২০ সালের বৈশ্বিক স’ন্ত্রাসবাদ সূচকে তাই এই অঞ্চলকে স’ন্ত্রাসবাদের সবচেয়ে গু’রুতর ঝুঁ’কিতে থাকা অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, র‍্যা’বের সদা তৎপর অ’ভিযান এবং অতন্দ্র প্রহরার কারণে এই সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার বাকি দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে বাংলাদেশ।

তবে মা’র্কিন নি’ষেধাজ্ঞা যে র‍্যা’বের স’ন্ত্রাসবাদ বি’রোধী কার্যক্রমে বা’ধার সৃষ্টি করবে, তা অস্বস্তিকর হলেও সত্য। আর গত দুই দশকের অভিজ্ঞতা থেকে ওয়াশিংটন জানে, স’ন্ত্রাসের প্রেত সীমানা মানে না। তাই দীর্ঘস্থায়ী নিরাপত্তার চিন্তা মাথায় রেখে স’ন্ত্রাসবাদ ঠে’কাতে নি’ষেধাজ্ঞা নয় বরং দ্বিপাক্ষিক সংলাপের মধ্য দিয়ে র‍্যা’বের সংস্কারের ও’পর জো’র দিবে ওয়াশিংটন, এটাই কাম্য।

তন্ময় চৌধুরী ।। গবেষক
সুত্রঃ ঢাকাপোস্ট