শামীম ওসমানকে দিয়ে টোপ, যেভাবে ফাঁদে পা দিয়েছেন তৈমূর

| আপডেট :  ২২ জানুয়ারি ২০২২, ১২:১৩ অপরাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২২ জানুয়ারি ২০২২, ১২:১৩ অপরাহ্ণ

সদ্য সমাপ্ত নাসিক নির্বাচনে খন্দকার তৈমূর আলম কেমন করে প্রার্থিতার ফাঁ’দে পা দিয়েছিলেন এবং বিপুল ভোটে পরাজিত হলেন তার নেপথ্য কারণটা কৌতূহলোদ্দীপক। ২০১৮ সালের বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন এবং জাতীয় নির্বাচনে ও ২০২০ সালের ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে প্রশাসন ও নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ম’দদে একটি দলের রাজনৈতিক কর্মীরা সংঘবদ্ধভাবে ভোট চু’রি ও ডাকাতি করে ১৪ দলের ৯৭.৩৩ শতাংশ প্রার্থীর জয় নিশ্চিত করার মাধ্যমে

নির্বাচনের মুখে যে অমোচনীয় কালি লেপন করেছিল তার পরিণাম ক্ষমতাসীন দলের জন্য ভালো হয়নি। ফলে দেশী-বিদেশী চা’পের মুখে বর্তমান নির্বাচন কমিশন ও স’রকারের শাসনামলে সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জ সিটির নির্বাচনে অতীতের কালিমা মুছে ফেলার তাগিদ ছিল। আর এ জন্য ডা. আইভীর মতো ক্লিন ইমেজের প্রার্থী যিনি ফিপটি ফিপটি স্বতন্ত্র কাম স’রকারি দলের প্রার্থী তার জয় স্মরণীয় করে রাখতে প্রতিদ্ব’ন্দ্বী হিসাবে খন্দকার তৈমূর আলমের মতো একজন ডাঁকসাইটে প্রার্থীর খুবই প্রয়োজন ছিল।

কিন্তু বেস’রকারি বি’রোধী দল যেহেতু ড. কামাল হোসেনের হাত ধরে ১৪ দলের নেতা মাননীয় সাথে গণভবনে দুই দফা গোলটেবিল বৈঠক করে একাদশ সং’সদ নির্বাচনে যায় এবং অধিকাংশ প্রার্থীর শুধু জামানত খোয়া গেছে তা-ই নয়, বি’রোধী দলের মর্যাদা পুনরুদ্ধারে ব্যর্থ হয়ে এই স’রকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশ না নেয়ার তওবা করে বসে থাাকে। ফলে নাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের মতো প্রার্থী স’ঙ্কটে পড়েছিল। এটা স্পষ্ট যে, স’রকারি বি’রোধী দল লাঙলকে প্রতিপক্ষ করে নাসিক নির্বাচন করলে তাতে জয়ী ডা. আইভী, স’রকার ও নির্বাচন কমিশনের ক্ষ’তিগ্রস্ত ভাবমূর্তি মেরামত করা সম্ভব হতো না। ফলে আগামী মাসে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা যখন রাষ্ট্রপতির সাথে বিদায়ী সাক্ষাৎ করতে যেতেন তখন রাষ্ট্রপতি ২০১৭ সালে কাজি রকিব কমিশনের বিদায়কালে নিষ্ঠা ও সততার সাথে দায়িত্ব পালনের জন্য যেভাবে প্রশংসা করেছিলেন সেইভাবে কে এম নূরুল হুদাকে প্রশংসিত করা রাষ্ট্রপতির জন্য বিব্রতকর হতো।

স্থানীয় স’রকার নির্বাচনে স’রকারি প্রতীক নাজে’ল হওয়ার আগে ২০১১ সালের নাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ছিলেন সং’সদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমান, বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী ছিলেন খন্দকার তৈমূর আলম। পৌর মেয়র ডা. আইভী ছিলেন নাগরিক কমিটির সমর্থিত প্রার্থী। শামীম ওসমানের প্রতি বিএনপির এলার্জি থাকায় খন্দকার সাহেব প্রতিদ্ব’ন্দ্বিতায় থাকলে শামীম ওসমান জয়ী হতে পারেন এ আ’শঙ্কায় বিএনপি ভোটগ্রহণের আগের দিন খন্দকার সাহেবকে কোরবানি দেয়ার মাধ্যমে তার মতে নিশ্চিত বিজয় হতে বঞ্চিত করায় তিনি দলের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন। সদ্যসমাপ্ত নাসিক নির্বাচন পর্যন্ত তিনি তার অসন্তোষ পুষে রেখেছিলেন।

২০১৮ সালের জাতীয় সং’সদ নির্বাচনে তিনি মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে দলের ও’পর ক্ষু’ব্ধ হলেও মনোনয়নবঞ্চিত করার জন্য ৩০ ডিসেম্বর তিনি দলকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন কারণ, লাখ লাখ টাকা গচ্চা দেয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক স’রকারের অধীনে ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে শামীম ওসমান বিএনপির প্রার্থীর কাছে বিপুল ভোটে পরাজিত হওয়ায় ওই রাতেই দেশ ছেড়ে পা’লিয়ে যেতে বা’ধ্য হন। এক এগারো পর্যন্ত বিদেশে থাকতে হয়েছিল তাকে। সেই পুরোনো স্মৃ’তি এখনো তার মনে জাগ্রত। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর এক এগারোর নায়ক জেনারেল মইন ভারতের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী পরে রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের জামাইবাবু প্রণব মুখার্জির পরামর্শে যে নির্বাচন দিয়েছিলেন তাতে ১৪ দলের ২৬৫ জন প্রার্থী নির্বাচিত হন। এরপর ৩০/০৬/২০১১ তত্ত্বাবধায়ক স’রকার ব্যবস্থ বাতিল করে দিয়ে নির্বাচনকালীন ক্ষমতায় থাকার সাংবিধানিক ক্ষমতা অধিগ্রহণ করে আওয়ামী লীগ। ২০০৮ সালে নির্বাচিতদের যারা ২০১৪ ও ২০১৮ সালেও মনোনয়ন পেয়েছিলেন তাদের এবং ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে যারা নতুন মনোনয়ন পেয়েছিলেন ভোটের জন্য তাদের আর জনগণের দুয়ারে হা’না দিতে হয়নি।

এই সৌভাগ্যবানদের মধ্যে শামীম ওসমান, ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমামের মনোনীত লক্ষ্মীপুরের কথিত আদম ব্যবসায়ী শহীদ ইসলামও রয়েছেন। শামীম ওসমান সদ্য সমাপ্ত নাসিক নির্বাচনে ডা. আইভী যত ভোট পেয়েছেন তার চেয়ে অনেক বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান তার প্রতিদ্ব’ন্দ্বী বিএনপির দুইবারের নির্বাচিত এমপি ডা. সালাউদ্দিন বাবুকে মাত্র চার লাখ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে রেকর্ড সৃষ্টি করেছিলেন। নাসিক নির্বাচনে খন্দকার তৈমূর আলমকে মাঠে নামিয়ে শামীম ওসমান তার হ্যাটট্রিক বিজয়ের জন্য নেত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন মাত্র। কারণ বিএনপির এই ত্যাগী নেতা ২০১১ সাল থেকে দলের প্রতি যে ক্ষো’ভ পুষে রেখেছিলেন তার সেই ক্ষো’ভকে জয়ের টোপ দিয়ে উসকে দিয়েছিলেন শামীম ওসমান। ডা. আইভীর অজান্তে দলের হাইকমান্ডের সাথে এমপি সাহেবের বোঝাপড়ার ভিত্তিতে এই কাজ তিনি করলেও খন্দকার সাহেব ঘুণাক্ষরেও তা যে টের পাননি। নির্বাচনী প্রচারণায় তার বাক্যচয়ন দেখেই তা বোঝা গিয়েছিল।

দলও তাদের ২০১১ সালের সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিল তা যাতে খন্দকার তৈমূর আলম সাহেব বুঝতে পারেন তাই তাকে পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে নাসিক নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্ব’ন্দ্বিতা করার সুযোগ করে দিয়েছিল। সিলেটের সাবেক মেয়র প্রয়াত বদরুদ্দিন আহম’দ কামরান জয়ের জন্য যেমন প্রশাসন, পুলিশ ও পোলিং অফিসার এবং পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্ট অর্থাৎ নিজের জনপ্রিয়তার ও’পর নির্ভর করায় মাত্র পাঁচ হাজার ভোটের ব্যবধানে আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন তেমনি নাসিক নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীর কাছে খন্দকার সাহেব অনুরূপ আচরণ আশা করেছিলেন।

কিন্তু ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বৃহত্তর চট্টগ্রাম জে’লায় একটি আসনে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ছাড়া বিএনপির একজন প্রার্থীও জয়ী হতে না পারলেও ১৮ মাস পরে ২০১০ সালের জুনে অনুষ্ঠিত চসিক নির্বাচনে হ্যাটট্রিক বিজয়ী মেয়র ঝানু রাজনীতিবিদ মহিউদ্দিন চৌধুরী তারই শিষ্য কাউন্সিলর মঞ্জুর আলমের কাছে লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে পরাজয়ের দুঃসহ স্মৃ’তি আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের হৃদয়ে ক্ষ’ত হিসেবে থেকে যায়।

এ কারণে ডা. আইভী হ্যাটট্রিক বিজয়ী প্রার্থী হওয়ায় ভোটারদের মনে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভোট দিতে না পারার স্মৃ’তি যদি মুছে না গিয়ে থাকে তাহলে সমূহ বি’পদ। তাই শামীম ওসমানের সাথে হাইকমান্ডের বোঝাপড়ার ভিত্তিতে এমপি সাহেব মেকআপ ছাড়াই এমন নিখুঁত অভিনয় করে গেছেন যা ডা. আইভী বুঝতে না পারায় এমপি সাহেবের সংবাদ সম্মেলনের পূর্বপর্যন্ত নির্বাচনী প্রচারণায় তার অভিব্যক্তিতে পরাজয়ের আভাস ফুটে উঠেছিল। নাগরিক সমাজকে আইভীর পক্ষে ধরে রাখতে শামীম ওসমানের এই অভিনয়ের প্রয়োজন যে ছিল তা হাই কমান্ড বুঝতে পারায় ওই ব্যবস্থা নিয়েছিল।

শামীম ওসমান খন্দকার সাহেবের বিশ্বাস অটুট রাখতে তার ছোট ভাইয়ের কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়া নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে বসিয়ে দিয়েছিলেন। ডা. আইভী ও সাংবাদিকরা এর সমালোচনা করেছিল। এমপি সাহেব তার অবস্থান পরিষ্কার করার জন্য যাতে সাংবাদিক সম্মেলন ডাকতে পারেন তার ক্ষেত্র সৃষ্টির লক্ষ্যেই পুলিশ খন্দকার সাহেবের নির্বাচন সমান্বয়ককে এজেন্টেদের তালিকাসহ হাতেনাতে গ্রে’ফতার করার পাশাপাশি আরো কয়েকজনকে গ্রে’ফতার করেছিল এবং বাকিদের বাসা তল্লা’শি অ’ভিযান ভোটগ্রহণের আগের রাত পর্যন্ত অব্যাহত রাখা হয়েছিল। একই সাথে এমপির অনুসারীদের বাড়িতে তল্লা’শি চা’লানো হয়েছিল।

প্র’তিবাদে সাংবাদিক সম্মেলনে এমপি সাহেবের বক্তব্য ছিল খুবই চাতুর্যপূর্ণ। তিনি বলেছিলেন নৌকা হারতে পারে না। ডা. আইভী জয়ী হলে তিলি বলবেন ড. আইভী নয় নৌকা জয়ী হয়েছে। আবার বাইচান্স আইভী পরাজিত হলে তিনি বলতে পারবেন, নৌকার নয় আইভীর পরাজয় হয়েছে। খন্দকার সাহেবের মতো ঝানু রাজনীতিবিদ এমপি সাহেব ও আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের মধ্যে পর্দার অন্তরালে যে খেলা চলেছিল তা কেন বুঝতে পারেননি সেই হিসাব কিছুতেই মিলছে না। তার সমর্থকদের গ্রে’ফতার ও বাসা তল্লা’শির প্র’তিবাদে ওই দিনই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালে আইভী হাত পাখার সাথে প্রতিদ্ব’ন্দ্বিতা করে জয়ী হলে স’রকারি দল ও তাদের সমর্থক বুদ্ধিজীবী সুশীল ও সাংবাদিকদের মুখ কালো হয়ে যেত।

উন্নয়ন করেই যদি ভোটে জেতা যেত তাহলে সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানকে জীবনের শেষ নির্বাচনে মৌলভীবাজার আসনে সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলীর মতো প্রার্থীর কাছে পরাজয় বরণ করতে হতো না। তার ছেলে নাসের রহমানের ক্ষমতার দাপট প্রদর্শনের দায় তাকে নিতে হয়েছিল। ভোট পাওয়ার জন্য উন্নয়নের পাশাপাশি সুশাসনেরও প্রয়োজন রয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে অনুষ্ঠিত সব নির্বাচনে জনগণ ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের মতো বা ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের মতো অবাধে ভোটদানের সুযোগ হা’রানোর কারণে ১৪ দলীয় স’রকার ও তাদের বশংবদ, প্রশাসন, পুলিশ ও পোলিং অফিসারদের বিশ^াসযোগ্যতা তলানিতে ঠেকার পরেও খন্দকার সাহেব কিভাবে বিশ^াস করেছিলেন তারা ১৯৯৪ সালের ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের মতো নির্বাচন উপহার দিয়ে ডা. আইভীর পরাজয় নিশ্চিত করবেন।

ডা. আইভীর মতো প্রার্থীর জয় নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় নেতাদের নারায়ণগঞ্জে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে কেন? জয়ের ব্যাপারে ডা. আইভী যদি শতভাগ নিশ্চিত থাকতেন তাহলে কেন্দ্রীয় নেতাদের বলতেন, আপনারা নারায়ণগঞ্জে এসে আমার জয় প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ কাউকে দেবেন না। কেন্দ্রীয় নেতারা যদি আইভী ও শামীম ওসমানের বি’রোধ নিষ্পত্তি করতেই নারায়ণগঞ্জে এসে থাকেন তাহলে দু’জনের উপস্থিতিতে একটি বৈঠকও হলো না কেন? ভোটগ্রহণের তিন দিন আগে থেকেই বহিরাগতদের অবস্থান বেআইনি হলেও কেন্দ্রীয় নেতারা ভোটগ্রহণের আগের দিন অফিস সময়ের পরে ডিসি এসপির সাথে ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক করেছিলেন কেন?

এখন দেখা যাক আম ভোটারদের কিভাবে প্র’তারিত করা হয়েছিল। ভোটার তালিকা থেকে ভুয়া ভোটারদের তাড়াতে ২০০৭ সালে এক এগারো ঘটিয়ে ফটোযুক্ত ভোটার তালিকা তৈরির নামে শহরের অধিকাংশ আমভোটারকে ঝেটিয়ে বিদায় করার কারণে দুই কোটি অধিবাসীর ঢাকা শহরের ভোটার সংখ্যা যেমন ৫০ লাখ হয়েছে তেমনি ২০ লাখ অধিবাসীর নাসিকের ভোটার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখে। ফটোযুক্ত ভোটার তালিকা কী ভোটারের সঠিক পরিচয় নির্ণয়ে কার্যকর নয়? তবে কেন ইভিএম ভোটাররা যেটিকে ইভিল ভোটিং মেশিন বলে উপহাস করে থাকে তাতে ভোটারের পরিচয় নিশ্চিত হতে আঙুলের ছাপ মেলার প্রয়োজন পড়ে? ইভিএমের জনক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট দিতে গিয়ে তার আঙুলের ছাপ না মেলায় বিড়ম্বনায় পড়েছিলেন। ডা. আইভীর জয় স্মরণীয় করে রাখতে ইভিল ভোটিং মেশিনের মাধ্যমে ভোটার শনাক্ত করে ভোটদানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আম ভোটারের আঙুলের ছাপ মেলাতে মেলাতে স’রকারি দলের সুহৃদগণ মেয়র পদে ইভিল ভোটিং মেশিনের বাটনে নৌকা প্রতীকে চা’প দেওয়ার অ’পকর্মটি সম্পন্ন করেছেন। গো’পন কক্ষের ভিতরে তিনটি ইভিএম এমনভাবে বসানো থাকে যাতে পর্দার নিচের ফাঁক দিয়ে যে কেউ বাটনে চা’প দিতে পারেন বা ফাঁক দিয়ে ইভিএম বাইরে এনে বাটনে চা’প দিয়ে সাথে সাথে ভিতরে ঢুকিয়ে দিতে পারে। আঙুলের ছাপ মেলার পর ভোটার গো’পন কক্ষে গিয়ে কাউন্সিলরদের দু’টি ও মেয়রের একটি ইভিএমে সংশ্লিষ্ট প্রতীকে চা’প দিলেও ইভিএম কাউন্সিলরদের দু’টি ভোট গ্রহণ করলেও মেয়রের ভোটটি আগেই দিয়ে দেওয়ার কারণে তা যে আর গ্রহণ করেনি তা আম ভোটাররা কিছুই বুঝতে পারেননি।

এই লেখক ১৯৭০ সাল থেকে ভোট দিয়ে এলেও একজন প্রথম শ্রেণির স’রকারি কর্মকর্তা হিসেবে ২০০৭ সালে অবসর গ্রহণের পর ২০২১ সালে ইভিল ভোটিং মেশিনে ভোট দান করতে গিয়ে যে তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন তা ভোলার মতো নয়। বয়সজনিত কারণে তার আঙুলের ছাপ মেলাতে বেশ কয়েকবার কসরত করতে হয়েছিল। আঙুলের ছাপ মেলার সাথে সাথে ভোট কক্ষের পর্দার পাশে দাঁড়ানো নৌকার লোক কোন ফাঁকে মেয়রের ভোটটি দিয়ে ফে’লেছিলেন তা বোঝা সম্ভব হয়নি। গো’পন কক্ষে গিয়ে দু’টি ভোট দিয়ে বাইরে এসে মেয়রের ইভিএম কোথায় জিজ্ঞাসা করলে সাথে সাথে কর্কশ স্বরে উত্তর দেওয়া হয়েছিল, আপনার ভোট হয়ে গেছে গণ্ডগোল না করে চলে যান। মেয়রের ইভিএম পর্দার বাইরে দেখে তিনি প্র’তিবাদ করায় তারা পুলিশ ডাকে। একজন এসআই এসে প্র’তিবাদকারীকে বাইরে নিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, আপনি অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ বয়সী। একা প্র’তিবাদ করে অযথা মেয়রের চক্ষুশূল হতে যাচ্ছেন কেন? আপনার ভালোর জন্যই বলছি, চলে যান না হলে পরে দেখতে পাবেন আপনার বাড়ির হোল্ডিং ট্যাক্স তিনগুণ হয়ে গেছে। আপিল করেও কমাতে পারবেন না।

২০২১ সালের পৌর নির্বাচনে ইভিএমের মাধ্যমে বর্ণিত উপায়ে ভোটগ্রহণ করায় বিএনপির ৯৫ শতাংশ প্রার্থী পরাজিত হয়েছিল। যার মধ্যে ৯০ শতাংশের জামানত খোয়া গিয়েছিল। ক্ষমতায় থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্ব’ন্দ্বিতা করতে পারলে জয় যে কত সহজ তা ডা. আইভীর পিতা মরহুম আলী আহম্মেদ চুনকা ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারির সং’সদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হাজী জালালের কাছে বিপুল ভোটে পরাজিত হয়েই টের পেয়েছিলেন। কারণ এক বছর পাঁচ মাস আগে ১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত নাপৌস নির্বাচনে হাজী জালাল আইভীর পিতার কাছে ১৬ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিলেন। বি’রোধী দলে থাকলে তত্ত্বাবধায়ক স’রকারের প্রয়োজন আছে আর ক্ষমতায় থাকলে তার প্রয়োজন নেই এই দ্বিমুখী নীতিতে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগ ও তাদের সমর্থক বুদ্ধিজীবী, সুশীল ও সাংবাদিকরা ২০০৭ সালে বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন নিরপেক্ষ নন তাই তার অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন বন্ধ জেনারেল মইনের এক এগারো ঘটানো সঠিক ছি। ২০১৩ সালে এসে তারাই বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মন্ত্রিসভা ও ২৬৫ জন এমপি সবাই সাবেক রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিনের তুলনায় বেশি নিরপেক্ষ বিধায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যারা যাবে না তারা পাকিস্তানপন্থী অপশক্তি। অথচ ভারতের পররাষ্ট্র স’চিব সুজাতা সিং এসে জাতিসঙ্ঘের মহাস’চিবের দূত তারানোকোকে হটিয়ে জেনারেল এরশাদের সহায়তায় ১৫৪ জনের বিনাভোটে জয় নিশ্চিত করলেও সেই ব্যাপারে ওই এলিট গোষ্ঠী নিশ্চুপ ছিলেন। কেন?

নাসিক নির্বাচন নাকি নির্বাচনের রোলমডেল হয়েছে। এমন উপসম্পাদকীয় প্রাপ্ত ভোট সংখ্যা ফাঁকা রেখে আগেই লেখা ছিল। ফলাফল ঘোষণার পর উক্ত ফাঁকা পূরণ করে পত্রিকার ১৭ জানুয়ারির সংখ্যায় তা ছাপা সম্ভব হয়েছে। ভালো নির্বাচন হয়েছে এমন মন্তব্য কে এম নূরুল হুদা করলে কেউ বিশ^াস করত না বিধায় কমিশনার মাহবুব তালুকদারকে নারায়ণগঞ্জ পাঠানো হয়েছিল। যেহেতু ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ আছে এবং থাকবে তাই ভোটকেন্দ্রে গিয়ে খন্দকারকে জয়ী করে কে চাইবেন নিজেদের বি’পদ ডেকে আনতে। যার কারণে ৫০ শতাংশ ভোটার ভোটকেন্দ্রে যাননি। ভোটারদের এমপির কাছে যাওয়ার প্রয়োজন না পড়লেও জন্ম, মৃ’ত্যু ও উত্তরাধিকারীর স্বীকৃতি পেতে কাউন্সিলরদের কাছে যেতেই হয়।

তাই স্থানীয় নির্বাচনে ভোটারদের বা’ধ্য হয়ে ভোটকেন্দ্রে যেতে হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের বাড়ির মালিকরা প্রভাবশালী বিধায় ভোটকেন্দ্রে না গেলে তাদের ঘাটানোর সাহস কাউন্সিলরদের নেই। তাই ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যথাক্রমে ২৫ ও ২০ শতাংশ ভোট পড়েছিল। নাসিক নির্বাচনের দিন চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও যশোরে ঝিকরগাছা পৌরসভায় কেমন নির্বাচন হয়েছে তা নারায়ণগঞ্জের উল্লাসের চা’পায় ঢাকা পড়েছে। ভোটাররা এ অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি পেতে চান। কিন্তু তাদের পথের সন্ধান দেয়ার মতো আস্থাভাজন রাজনৈতিক নেতা ও বুদ্ধিজীবীর হাল জমানায় খুবই অভাব।সূত্রঃ অন্য এক দিগন্ত