এই জীবন বড় বেদনার

| আপডেট :  ৬ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:৫৬ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ৬ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:৫৬ পূর্বাহ্ণ

লাল ও সাদা চেকের জামা, টুকটুকে লাল পায়জামা ওড়না গায়ে দেওয়া কিশোরী শখ করে নাক ফুঁড়িয়েছে, তাতে পাথরের একটি নাকফুল চিকচিক করছে। সুন্দর করে হাসে মেয়েটি। তবে নড়াচড়া করতে গেলেই মুখে ক’ষ্টের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ক্যাথেটার হাতে নিয়ে হয় বাবা না হয় মায়ের হাতটা ধরে হাঁটতে হয়। কয়েক দিন আগের বড় অ’স্ত্রোপচারের ধকলটা তখন আরও স্পষ্ট হয়। মেয়েটির বয়স এখন ১০ বছর। ২০১৬ সালের ১৮ অক্টোবর মাত্র পাঁচ বছর বয়সে দিনাজপুরে ৩৮ বছর বয়সী এক ব্যক্তি মেয়েটিকে ধ”ণ করেছিলেন।

ধ”ণের আগে ব্লেড বা ধা’রালো কিছু দিয়ে মেয়েটির যৌ’নাঙ্গ কে’টে দিয়েছিলেন। সারা গায়ে দিয়েছিলেন জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা। ধ”ণের পরে মেয়েটির হাত-পা বেঁ’ধে, মুখে টেপ পেঁ’চিয়ে হলুদখেতে ফে’লে রেখেছিলেন। সে অবস্থায় মেয়েটিকে উ’দ্ধার করেছিল তার পরিবার। তারপর থেকেই এই পুরো পরিবারের জীবনটাই পাল্টে গেছে। মেয়েটিকে বাবা ও মায়ের হাত ধরে পথ চলতে হচ্ছে। ঘটনার পর থেকে মেয়েটি প্রস্রাব নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। দুই দিনেই লাগে ৬০০ টাকার ডায়াপার (প্যাকে’টে ১০টি ডায়াপার থাকে)।

তবে সব সময় ডায়াপার কেনার টাকা থাকে না, তখন পুরোনো কাপড় পরতে হয়। আর এতে করে মেয়েটির দুই ঊরুতে মাঝে মাঝেই ঘায়ের মতো হয়ে যায়। চার মাস ধরে মেয়েটির মাসিক শুরু হয়েছে। তখন পরিস্থিতি আরও ভ’য়াবহ হয়, ডায়াপারের ভেতর স্যানিটারি ন্যাপকিন পরতে হয়।ঘটনার পর মেয়েটিকে আ’দালতে গিয়ে আ’সামির বি’রুদ্ধে সাক্ষ্যও দিতে হয়েছে। দীর্ঘদিন তাঁর বাবা ছাড়া অন্য কোনো পুরুষমানুষ দেখলে ভ’য়ে কুঁকড়ে যেত। এখনো ট্রমা পুরোপুরি কাটেনি। আজ রোববার দুপুরে রাজধানীর একটি রেস্টহাউসে কথা হয় মেয়ে ও তার মা–বাবার সঙ্গে। আমরাই পারি পারিবারিক নি’র্যাতন প্রতিরোধ জোট (উই ক্যান) নামের একটি প্ল্যাটফর্মের তত্ত্বাবধানে আছে মেয়ে ও তার পরিবার। আর এই পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, স্থানীয় সংগঠন পল্লিশ্রী ফাউন্ডেশনসহ একাধিক সংগঠন।

২০১৬ সালের ঘটনার পর থেকে মেয়েটি ও তার পরিবারের সদস্যদের বেশির ভাগ সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার, হাসপাতালটির শি’শু সার্জারি বিভাগ, বার্ন ইউনিটসহ বিভিন্ন হাসপাতালেই দিন পার করতে হচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রজনন অঙ্গে কয়েক দফায় অ’স্ত্রোপচার হয়েছে। মেয়েটির বাবা কৃষিকাজ করে আর মাছ ধরে সংসার চালান। তবে ঢাকা-দিনাজপুর যাতায়াত করতে করতে কাজে ব্যাঘাত ঘটছে। এই সংখ্যালঘু দম্পতির সাড়ে চার বছর বয়সী আরেক ছেলে আছে। এই ছেলেকে হয় নানির কাছে থাকতে হয়, আর না হয় নানি এসে মেয়েটির সঙ্গে ঢাকায় হাসপাতালে থাকেন। তখন মেয়েটির মা ছেলের সঙ্গে বাড়িতে থাকেন। এবার মেয়েটি পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় এসেছিল গত ১৩ সেপ্টেম্বর। ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালে সহযোগী অধ্যাপক (ইউরোলজি) মো. ফয়সাল ইসলামের অধীনে ভর্তি ছিল। হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে গত ২৭ নভেম্বর মেয়েটির অ’স্ত্রোপচার করেছেন মো. ফয়সাল ইসলাম।

সহযোগী অধ্যাপক (ইউরোলজি) মো. ফয়সাল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মেয়েটির ‘ব্লাডার নেক রি-কনস্ট্রাকশন’ সার্জারি হয়েছে। সহজভাবে বললে, মেয়েটি ধ”ণের শি’কার হওয়ার পর থেকে প্রস্রাব নিয়ন্ত্রণ করতে পারত না। ধ”ণের সময় ধা’রালো কিছু দিয়ে যো’নিপ’থ কে’টে দেওয়ায় মেয়েটির প্রস্রাবের রাস্তা, আশপাশের নার্ভসহ মূত্রথলি ক্ষ’তিগ্রস্ত হয়েছিল। মেয়েটি যাতে প্রস্রাব নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, অ’স্ত্রোপচারের মাধ্যমে সে চেষ্টা করা হয়েছে।

এবার অ’স্ত্রোপচারের পর মেয়েটি কেমন আছে, এ প্রশ্নের উত্তরে মো. ফয়সাল ইসলাম বলেন, ‘এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। মেয়েটির এ অ’স্ত্রোপচারের আগেও ক্যাথেটার লাগানো ছিল। মেয়েটিকে ডায়াপার পরে থাকতে হয়। তখন ক্যাথেটার থাকার পরও ডায়াপার ভিজে যেত। তবে অ’স্ত্রোপচারের পর ডায়াপার ভিজছে না। এতে আমি আশাবা’দী। তবে এখনই এ বি’ষয়ে চূড়ান্ত কোনো মন্তব্য করার সময় আসেনি। ৫ শতাংশ ক্ষেত্রে ভালো হওয়ার চান্সও যদি থাকে, তাই নেওয়ার চেষ্টা করলাম। আমরা চেয়েছি মেয়েটি যাতে স্বাভাবিকভাবে প্রস্রাব করতে পারে। এতে করে সে গুণগত জীবন কা’টানোর সুযোগ পাবে। তবে এটি সফল না হলে মেয়েটির পেটে নল লাগিয়ে বিকল্প পথে প্রস্রাব করানোর ব্যবস্থা করা হবে।’

চিকিৎসক ফয়সাল ইসলাম জানালেন, এই অ’স্ত্রোপচারে ছয় থেকে সাত লাখ টাকা লাগে। তবে মেয়েটির চিকিৎসা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ করেছে বিনা মূল্যে। বললেন, ‘মেয়েটির শা’রীরিক অবস্থা দেখে আমি নিজেই ইমোশনাল হয়ে পড়ি।’ ২ ডিসেম্বর মেয়েটি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে। তারপর থেকে থাকছে একটি রেস্টহাউসে। ১০ বছরের মেয়েটি বর্তমানে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। ক’রোনার মধ্যে সেভাবে স্কুলে যেতে পারেনি। তবে মিষ্টি হেসে জানাল, তার পড়তে ভালো লাগে। পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে। পাশে বসা মা জানালেন, তাঁর মেয়ে সাজতে পছন্দ করে। নাচতে চায়। তবে সে তো ভালো করে একা হাঁটতেই পারে না—বলেই এই মা খানিকটা হতবিহ্বল হয়ে পড়লেন।

আমরাই পারি পারিবারিক নি’র্যাতন প্রতিরোধ জোটের প্রধান নির্বাহী জীনাত আরা হক পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার জন্য হাসতে হাসতে বললেন, শুধু সাজুগুজু বা নাচ নয়, ও ছবিতে রং করতে পছন্দ করে। মুরগির মাংস আর বিরিয়ানি পছন্দের খাবার। বললেন, ‘ও একটু ভালো হলেই আমরা কী কী মজা করব, তার তালিকা তৈরি করছি।’ তবে একটু আড়ালে গিয়ে প্রতিবেদককে বললেন, অ’স্ত্রোপচারের আগে মেয়েটির বিভিন্ন পরীক্ষা–নিরীক্ষার বি’ষয়টি ছিল ভ’য়াবহ রকমের ক’ষ্টের। টেকনিশিয়ানরা পর্যন্ত মেয়েটির ক’ষ্ট দেখে চোখের পানি ফে’লেছেন। মেয়েটিকে যখন বলা হতো আর একটু ক’ষ্ট কর, তখন মেয়েটি বলত, ‘আমি তো সারা জীবনই ক’ষ্ট করছি।’

জীনাত আরা হক জানালেন, তাঁরা প্ল্যাটফর্মের পক্ষ থেকে ২০১৮ সালের শেষ দিকে পরিবারটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। বিভিন্ন সংগঠনও এগিয়ে এসেছে। ব্যাংকের মাধ্যমে পরিবারটির জন্য অর্থসহায়তা গ্রহণ করা হচ্ছে। তার হিসাব রাখা হচ্ছে। সেই টাকা থেকেই যখন যা প্রয়োজন, তা খরচ করা হচ্ছে। রেস্টহাউসে থাকা ফ্রি। তবে মেয়েটির যেহেতু ভালো খাবার খাওয়া জরুরি, তাই তার বাবা বাজার করে আনেন, আর মেয়েটির মা তা রান্না করে খাওয়ান।

মেয়েটির পুনর্বাসন প্রসঙ্গে জীনাত আরা হক বলেন, ‘সবার আগে তাকে সুস্থ করে তোলা জরুরি। মেয়েটির বাড়িতে কোনো টয়লেট নেই, জঙ্গলে যেতে হয়, যা মেয়েটির জন্য খুব ক’ষ্টের। এত আগের ঘটনা, এখনো চিড়িয়াখানার জন্তু দেখার মতো মেয়েটিকে দেখার জন্য বাড়িতে ভিড় লেগে যায়। মেয়েটির ট্রমা কা’টানোর জন্য দীর্ঘ মেয়াদে কাউন্সেলিং করা প্রয়োজন। মা’মলার ফলাফল মেয়েটির পরিবারের পক্ষে না থাকলে পরিস্থিতি তখন কোন দিকে মোড় নেবে, তা–ও বলা যায় না। সব মিলিয়ে মেয়েটিকে অন্য কোনো জায়গায় পুনর্বাসন এবং ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করাও জরুরি।’

ঘটনার পর মেয়েটির বাবা ২০১৬ সালের ২০ অক্টোবর দিনাজপুরের পার্বতীপুর মডেল থানায় নারী ও শি’শু নি’র্যাতন দ’মন আইনের অ’পহরণপূর্বক ধ”ণ করে হ’’ত্যার চেষ্টা ও সহযোগিতা করার অ’পরাধে মা’মলা করেন। ওই বছর ২৪ অক্টোবর প্রধান আ’সামি সাইফুল ইসলামকে গ্রে’প্তার করা হয়। তিনি এখনো কা’রাগারে আছেন। সাইফুল ইসলামের পরে আ’সামি আফজাল হোসেন কবিরাজকে গ্রে’প্তার করা হলেও তিনি জা’মিনে মুক্ত আছেন। নারী ও শি’শু দ’মন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মা’মলাটির শুনানি ও যুক্তিতর্ক শেষ হয়েছে গত মার্চ মাসে। গত ২৫ নভেম্বর মা’মলার রায় দেওয়ার কথা ছিল। তবে এখনো রায় ঘোষণা হয়নি।

গত বছরের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে এ মা’মলার বিচার শেষ করে চলতি বছরের ৩১ মার্চের মধ্যে আ’দালতে প্রতিবেদন দিতে দিনাজপুরের নারী ও শি’শু নি’র্যাতন দ’মন ট্রাইব্যুনালকে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত এ আদেশ দেন। আইনে নির্ধারিত সময়ে মা’মলার বিচার শেষ না হওয়ার বি’ষয়টি নজরে আনা হলে শুনানি নিয়ে এই আদেশ দেওয়া হয়। স’রকারি খরচে শি’শুটির চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা করতে স্থানীয় মহিলা ও শি’শুবি’ষয়ক কর্মকর্তা এবং সমাজসেবা কর্মকর্তাকেও নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।

নির্ধারিত সময়ে মা’মলা শেষ না হওয়ার বি’ষয়টি এরই মধ্যে আ’দালতের নজরে এনেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আতাউল্লাহ নূরুল কবীর। এ বি’ষয়ে আইনজীবীকে সহায়তা দেয় ‘আমরাই পারি পারিবারিক নি’র্যাতন প্রতিরোধ জোট’।

দিনাজপুরের নারী ও শি’শু দ’মন ট্রাইব্যুনালের বিশেষ পিপি তৈয়বা বেগম টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি গত বছরের মার্চ মাসে এ মা’মলার সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। অ’ভিযুক্ত আ’সামির ডিএনএ টেস্ট করা, সাক্ষ্য প্রমাণসহ মা’মলার সার্বিক কার্যক্রম শেষ করেছি। কিন্তু আ’দালত কেন রায় দিচ্ছেন না, তা তো আমি বলতে পারব না। আমি শুধু বলতে পারি, মেয়েটি আর মেয়েটির পরিবার বুঝতে পারছে, তারা কতটা য’ন্ত্রণার মধ্য দিয়ে দিন পার করছে।’

মেয়ের নির্যাতকের সর্বোচ্চ শা’স্তি দাবি করেছেন তার মা–বাবা। তাঁরা বলছেন, আ’সামিদের দৃষ্টান্তমূলক শা’স্তি হলে পরবর্তী সময়ে কেউ এ ধরনের অ’পরাধ করতে ভ’য় পাবে। সুত্রঃ প্রথম আলো