ঘরে ঘরে জাহাঙ্গীর

| আপডেট :  ২৮ নভেম্বর ২০২১, ১১:২৬ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২৮ নভেম্বর ২০২১, ১১:২৬ পূর্বাহ্ণ

অবশেষে ক্ষমতার মসনদ থেকে বেশ দ্রুত ও নাটকীয়ভাবে বিদায় নিতে হয়েছে দেশের বৃহত্তম সিটি করপোরেশন – গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে। জাহাঙ্গীর আলম কখনোই সুরাজনীতিক ছিলেন না। গুণ্ডামি, মা’স্তানি প্রভৃতি অ’পকর্মের মাধ্যমে তার উত্থান হয়েছিল। মানুষ তাকে ভ’য় পেত, সমীহ করত না। সেটি জাহাঙ্গীর জানতেন, জানত আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক মহলও। কিন্তু তা সত্ত্বেও সবাই চুপ করে থাকতেন। আওয়ামী লীগ ভালোবাসা দিয়ে কিছুই জয় করতে চায় না। বল প্রয়োগ ও ভীতি দেখানোর মাধ্যমে সবকিছু দ’খলে নিতে চায়। সেই প্রক্রিয়ায় জাহাঙ্গীর আলমকে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে দেশের বৃহত্তম সিটি করপোরেশনের মেয়র বানিয়ে দিয়েছে।

মেয়র হতে যদি ভোট লাগত তাহলে নিশ্চিত করেই বলা যায়, তার জামানত বাজেয়াপ্ত হতো; কিন্তু এখন বাংলাদেশে আজব গণতন্ত্র চালু হয়েছে। এখানে এক ব্যক্তির ইচ্ছায় কেউ মুহূর্তে বাদশাহ, পর মুহূর্তে মিসকিন। ভোট হয় না। ২০১৪ সাল থেকে স্থানীয় স’রকারই বলি, সং’সদ বলি, সিটি করপোরেশন কিংবা ইউপি চেয়ারম্যানই বলি, এক ব্যক্তির ইচ্ছাই সেখানে প্রধান। তিনি যদি বলেন ‘হও’ অমনি এমপি, মেয়র, চেয়ারম্যান হয়ে যাওয়া যায়। তারই ‘হও’ কার্যকর করার জন্য প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনী একেক সময় একেক কৌশল গ্রহণ করে। কখনো আগের রাতে ভোট কে’টে ব্যালট বাক্সে ভরে রাখে; কখনো প্রতিপক্ষকে ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে দেয় না। হা’মলা, হাঙ্গামা, গোলাগু’লি করে এমন এক আ’তঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে যে, ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে আসার আগ্রহই হা’রিয়ে ফে’লেন। এমনও তো হয়েছে, এক ব্যক্তির জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। অথচ তিনিই সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এমন আজব ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে কমই ঘটেছে।

নির্বাচনকে নিজের কব্জায় নিয়ে পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রে’সিডেন্ট আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্র চালু করেছিলেন। অর্থাৎ, প্রে’সিডেন্ট জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবেন না, নির্বাচিত হবেন ইউপি মেম্বার-চেয়ারম্যানদের ভোটে। তাতে অল্প চেয়ারম্যান-মেম্বারকে কিনে নেয়া সম্ভব হতো। এখন চালু হয়েছে আগের রাতে ভোট কিংবা ভোটকেন্দ্র দ’খলের ‘গণতন্ত্র’। এ কথা সবাই জানে, বিগত প্রায় প্রতিটি নির্বাচন এই পদ্ধতিতে হয়েছে। ১৯৭৩ সালে পার্লামেন্ট নির্বাচনে আরো একটি পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। সেটি হলো – যেখানে দেখা যাচ্ছিল বি’রোধীরা ভোটে জিতে যাচ্ছে, সেখানে ভোট গণনা বন্ধ করে বাক্সগুলো হেলিকপ্টারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল জে’লা নির্বাচনী কার্যালয়ে। তারপর যাকে খুশি তাকে ‘নির্বাচিত’ ঘোষণা করে দেয়া হচ্ছিল। এবারের ইউপি নির্বাচনেও বহু ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটেছে। যেখানে স’রকারি প্রার্থী হেরে যাচ্ছিলেন, সেখান থেকে ব্যালট বাক্স নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল উপজে’লা বা জে’লা কেন্দ্রে। তারপর যাকে খুশি তাকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছে। এর ব্যতিক্রম খুব একটা নেই।

জাহাঙ্গীর আলম নির্বাচিত হয়েছিলেন বহুমুখী কারসাজির মাধ্যমে। তিনি যে ভ‚মিদস্যু, ঝুটদস্যু, জি’ম্মিকারী তা এলাকার সবাই জানত। গাজীপুরে একটি দরিদ্র কৃষক পরিবারে ১৯৭৯ সালে জন্ম তার। এসএসসি পাসের পর ভর্তি হয়েছিলেন ভাওয়াল বদরে আলম স’রকারি কলেজে। অর্থনৈতিক টানাপড়েনের কারণে কলেজের লেখাপড়া শেষ করতে পারেননি। তার মামা ছিলেন ভাওয়ালের একটি বাড়ির কেয়ারটেকার। কিন্তু যুক্ত ছিলেন জমি কেনাবেচার দালালিতে। তখন জাহাঙ্গীর তার মামার এ কাজে যুক্ত হন। এলাকার একাধিক প্রবীণ ব্যক্তির ভাষ্য – ওই সময় এক কারখানার মালিকের জমি কেনার অনেক টাকা আ’ত্মসাৎ করেন জাহাঙ্গীর। অনুপার্জিত প্রচুর টাকার জো’রে আওয়ামী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।

তারপর শুরু করেন ঝুট ব্যবসায়। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। কোনো পদ-পদবি ছিল না। চলতেন একাধিক দেহরক্ষী নিয়ে। ভিভিআইপির আদলে তার গাড়িবহরের পেছনে থাকত একটি অ্যাম্বুলেন্স। জাহাঙ্গীরের অর্থ আয়ের সবচেয়ে বড় একটি খাত হলো গাজীপুর ও ময়মনসিংহ এলাকায় বিভিন্ন গার্মেন্ট কারখানার ঝুট এবং সুতার কারবার। একসময় তিনি নিজেই দেখভাল করতেন। এখন বিশ্বস্ত লোকদের দিয়ে করান। গাজীপুর এলাকার বিভিন্ন কারখানার ট্রেড লাইসেন্স আ’টকে দিয়ে টাকা আদা’য়ের অ’ভিযোগ আছে তার বি’রুদ্ধে।

জাহাঙ্গীরের হয়ে যারা গার্মেন্ট কারবার নিয়ন্ত্রণ করেন, সমকাল লিখেছে, তারা হলেন – মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বেনসন মুজিবর, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী মনির ও ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর আলম। মেয়রের সান্নিধ্যে থেকে এলাকায় কয়েক কোটি টাকা খরচ করে বাড়ি করেন কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর। এ ছাড়া মেয়রের দেহরক্ষী হিসেবে পরিচিত আশরাফুল আলম ওরফে রানা মোল্লা ইটাহাটা এলাকায় প্রাসাদোপম বাড়ি নির্মাণ করেছেন। কয়েক মাস গাজীপুরের টিআরজেট কারখানায় নিজে হাজির হয়ে ঝুট দেয়ার দাবি করেন মেয়র নিজেই। এলাকাবাসীর অ’ভিযোগ ছাড়াও একটি গো’য়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে তাদের চাঁ’দাবাজির তথ্য তুলে ধরা হয়। ঝুট ব্যবসার একক নিয়ন্ত্রণ বন্ধ ও উদ্ভূত পরিস্থিতি সঠিকভাবে মোকাবেলা করা না গেলে মেয়রপন্থী ও মেয়রবি’রোধী পক্ষের মধ্যে সঙ্ঘাতের আ’শঙ্কা ছিল।

তার এই অ’পকর্মের সাথে যারা যুক্ত তারা সবাই মেয়রের লোক ও আওয়ামী লীগ, যুবলীগের সদস্য। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কোটি কোটি টাকার কাজ, বাজার ও গরুর হাট ইজারা নিয়ে প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্য মেয়রের। এ ছাড়া টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমার নানা কাজের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। অ’ভিযোগ আছে, নিজের ও দলীয় বিলবোর্ড তিনি তৈরি করেন সিটি করপোরেশনের টাকায়। তিনি ‘জাহাঙ্গীর আলম ফাউন্ডেশন’ নামে একটি দাতব্য সংস্থা খুলে গড়ে তোলেন বড় লা’ঠিয়াল বাহিনী। মহানগরের ৫৭টি ওয়ার্ডে তাদের কার্যক্রম রয়েছে। এই ব্যানারে কাজ করে পাঁচ শতাধিক তরুণ-ত’রুণী। সিটি করপোরেশন থেকে তাদের বেতন দেয়া হয়। অ’ভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনার নামও নেয়া হতো না। জাহাঙ্গীরের নিজের পরিচয় তুলে ধরতে ওই ফাউন্ডেশনকে ব্যবহার করা হতো।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের একাধিক কাউন্সিলরের অ’ভিযোগ, প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন হ’’ত্যার ঘটনায় মেয়রের ভ‚মিকা স’ন্দেহজনক ও প্রশ্নবিদ্ধ। ওই ঘটনার পর সিটি করপোরেশন থেকে কোনো শো’কপ্রস্তাব গ্রহণ করা হয়নি। অন্য কোনো কর্মসূচিও পালন করেনি কেউ। অ’ভিযোগ আছে, একই প্রকল্প তিনবার দেখিয়ে ৩৮ কোটি টাকা আ’ত্মসাৎ করার চেষ্টা করেছিল একটি প্রভাবশালী চ’ক্র। এতে বা’ধা হয়ে দাঁড়ালে নির্বাহী প্রকৌশলী দেলোয়ারকে প্রা’ণ দিতে হয়। ওই হ’’ত্যাকাণ্ডের পর মেয়রের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত সুন্দর মনির কিছু দিন গাঢাকা দিয়ে থাকেন। তা ছাড়া গাজীপুরের রাস্তা সম্প্রসারণের নামে তিনি শিল্পপতিদের কাছ থেকে এমন মুচলেকা নিতেন যে, তারা স্বেচ্ছায় জমি দেবেন এবং কোনো ক্ষ’তিপূরণ নেবেন না। এরকম মুচলেকা দিতে কেউ অস্বীকার করলে তার ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করতে অস্বীকৃতি জানাতেন।

অবশেষে মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের ভাগ্যে বিপর্যয় নেমে আসে। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের বি’রুদ্ধে অগ্রহণযোগ্য কটূক্তি করে তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হন। সে ধারায় তিনি আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্য পদ হা’রান এবং গত বৃহস্পতিবার হা’রান মেয়র পদও। এভাবে মসনদ থেকে পতন ঘটে মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের। এখন জাহাঙ্গীর একা নন, ঘরে ঘরে এরকম আরো অনেক জাহাঙ্গীর আলমের জন্ম হয়েছে; কোথাও একা কোথাও বা ঝাঁকে ঝাঁকে।

গত ১৭ নভেম্বর টাঙ্গাইলে মওলানা ভাসানীর মাজারে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলেন গণ অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক ড. রেজা কিবরিয়া ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর। তখন ছাত্রলীগের কর্মীরা লা’ঠিসো’টা নিয়ে তাদের ও’পর হা’মলা চা’লায়। ওবায়দুল কাদের যদিও বলেছেন, হা’মলাকারীদের বি’রুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে; কিন্তু তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

ইউপি নির্বাচনে বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের নেতারা যে ভাষায় কথা বলছেন, যে ধরনের হু’মকি দিচ্ছেন তা জাহাঙ্গীর আলমের কার্যকলাপের চেয়ে কম নয়। কেউ বলছেন, ভোটের দিন তিনি একে-৪৭ রাইফেল নিয়ে বসে থাকবেন। যদি কেউ আওয়ামী লীগের বি’রুদ্ধে ভোট দিতে আসে তবে তার বি’রুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। কেউ বলছেন, প্রা’ণের মায়া থাকলে ‘তারা’ যেন ভোটকেন্দ্রে না যায়। কেননা, পুলিশ আমাদের, স’রকার আমাদের, প্রশাসন আমাদের। সুতরাং তাদের কথার অন্যথা যেন না হয়। যশোরের বাঘারপাড়া উপজে’লার জহুরপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান দীন মোহাম্ম’দ দিলু বলেছেন, নৌকার বাইরে যারা ভোট দিতে চান তাদের কেন্দ্রে যাওয়ার দরকার নেই।

এসব নির্বাচনী আচরণবিধি ল’ঙ্ঘনের দেখভাল করার কথা ছিল নির্বাচন কমিশনের। যেসব ব্যক্তি এ ধরনের কথা বলছেন তাদের বি’রুদ্ধে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার দরকার ছিল। যদি এক জায়গায় ব্যবস্থা নেয়া হতো তাহলে দশ জায়গা নিয়ন্ত্রণে চলে আসত। কিন্তু ঠুঁটোজগন্নাথ নির্বাচন কমিশন চোখে ঠুলি পরে মুখে কুলুপ এঁটে চুপচা’প বসে আছে।

গাজীপুরের সদ্য অপসারিত জাহাঙ্গীর আলম যে এ ধরনের নিকৃষ্ট অ’পকর্মের সাথে জ’ড়িত সেটি জানতেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রায় সবাই। ‘এমন লোক’ই চাই যে বি’রোধীদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিতে পারে, দুটি পয়সা না হয় কামাচ্ছে, তাতে কী যায়-আসে? ভবি’ষ্যতে ভোটের সময় এ পয়সার কিছু অংশ তো তাদেরও কাজে লাগবে। কিন্তু ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের দানবদের এভাবে বাড়তে দিলে একসময় তারা মালিকের ঘাড়ও মটকায়, তাদের অনুভূতির সর্বোচ্চ জায়গায় আ’ঘাত করে।

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
[email protected]
সূত্রঃ নয়া দিগন্ত