মুমিন নারীকে মহানবী (সা.) যেসব উপদেশ দিয়েছেন

| আপডেট :  ২৫ নভেম্বর ২০২১, ১২:৫৩ অপরাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২৫ নভেম্বর ২০২১, ১২:৫৩ অপরাহ্ণ

ইসলামপূর্ব জাহেলি আরব সমাজে নারীর কোনো মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান ছিল না। তাদের গণ্য করা হতো ভোগের বস্তু হিসেবে। পরিবারের পুরুষ সদস্যের মর্জির ওপর নির্ভর করত তাদের জীবন ও জীবিকা। এমনকি সামাজিক লজ্জার ভয়ে নারীকে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো। ইসলাম নারীর জীবনের, বরং মর্যাদাপূর্ণ জীবনের অধিকার দেয়।

নারীর প্রতি তৎকালীন সামাজিক মনোভাবের তীব্র প্রতিবাদ করে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়, ‘যখন তাদের কন্যাসন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয়, মনঃকষ্টে তাদের চেহারা কালো হয়ে যায়। তাদের যে সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে তার কারণে তারা নিজ সম্প্রদায়ের লোক থেকে মুখ লুকিয়ে রাখে। তারা ভাবে এই সন্তান রাখবে, নাকি মাটিতে পুঁতে ফেলবে। সাবধান! তাদের সিদ্ধান্ত কতই না নিকৃষ্ট।’ (সুরা নাহল, আয়াত : ৫৮-৫৯)

নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় হাদিসেও একাধিক নির্দেশ ও নির্দেশনা এসেছে। মহানবী (সা.) বিদায় হজের ভাষণে নারীর প্রতি সুবিচার করার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘তোমরা নারীদের ব্যাপারে ভালো উপদেশ দাও।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং : ৫১৮৫) একইভাবে মহানবী (সা.) মর্যাদাপূর্ণ জীবন লাভের জন্য নারীদেরও কিছু নির্দেশ ও নির্দেশনা দিয়েছেন। নারীদের প্রতি মহানবী (সা.)-এর কয়েক নির্দেশনা ও পরামর্শ তুলে ধরা হলো—

তাকওয়া অর্জন : তাকওয়া বা খোদাভীতি মুমিনজীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ। ইসলামে মানুষের মর্যাদা ও সম্মান নির্ধারিত হয় তাকওয়ার মাধ্যমে। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় তোমাদের ভেতর সেই ব্যক্তি সবচেয়ে সম্মানিত, যে সবচেয়ে বেশি খোদাভীরু।’ (সুরা হুজরাত, আয়াত : ১৩)

মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা পাথেয় অর্জন করো। নিশ্চয় সর্বোত্তম পাথেয় তাকওয়া। তোমরা আমাকে ভয় করো হে জ্ঞানী ব্যক্তিগণ!’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৯৭)
তাকওয়া বা খোদাভীতির অর্থ হলো আল্লাহর ভয়ে যাবতীয় পাপ ও পাপাচার, অন্যায় ও অবিচার, মন্দ ও নিন্দনীয় কাজ থেকে বিরত থাকা। আল্লাহর নির্দেশ মান্য করে চলা। রাসুলুল্লাহ (সা.) নারীদের তাকওয়া অর্জনের নির্দেশ দিয়েছেন। উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.)-কে তিনি বলেন, ‘হে আয়েশা, তোমার জন্য আবশ্যক হলো খোদাভীতি অর্জন করা।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৯৭৮)
তাকওয়া নারীকে যাবতীয় স্খলন ও প্ররোচনা থেকে রক্ষা করতে পারে। তাকে শৃঙ্খলাপূর্ণ আদর্শ জীবনে অনুপ্রাণিত করতে পারে।

ছোট ছোট পাপ পরিহার করা : ইসলামী শরিয়তের বিধি-ব্যবস্থা মতে নারী তার পিতা, ভাই, স্বামী ও পুত্রের পক্ষ থেকে যে ভরণ-পোষণ লাভ করে তার সবই হালাল। যদি না নিজে কোনো কাজের মাধ্যমে তা হারামে রূপান্তর করে। যেহেতু নারী সব সময় বা বেশির ভাগ সময় হালাল রিজিক খায়, তাই ইসলামবেত্তাদের অভিমত হলো, নারীর জন্য জান্নাতে প্রবেশ করা পুরুষের তুলনায় সহজ। এ জন্য তাকে ছোট ছোট মন্দ স্বভাব ও পাপ কাজ পরিহার করতে হবে।

নারীসমাজের অনেকের ভেতর পরচর্চা, পরশ্রীকাতরতা ও হিংসার প্রবণতা দেখা যায়। এ ছাড়া সময় ও অর্থ অপচয়, টিভি ও সিরিয়ালের মতো অর্থহীন কাজে আসক্তি রয়েছে অনেক নারীর, যা ইহকাল ও পরকালে তাকে ক্ষতিগ্রস্তই করে। অনেক সময় নারীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকেও ব্যাহত করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) নারীদের ছোট ছোট গুনাহ পরিহারের নির্দেশ দিয়েছেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘হে আয়েশা, আমল বিনষ্টকারী বিষয় (ছোট গুনাহ) থেকে বেঁচে থাকো। কেননা আল্লাহ তা প্রত্যাশা করেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪৩৮৪)

ছোট ছোট মন্দ অভ্যাস ও পাপকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অথচ এর পরিণতি ভয়াবহ। আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, ‘আজ তোমরা কোনো কোনো কাজকে চুলের চেয়ে ছোট (তুচ্ছ অর্থে) মনে করো, অথচ আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে তাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ মনে করতাম।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৩)

সময়মতো নামাজ আদায় : ইসলাম নারীকে ঘরে নামাজ আদায় করতে উৎসাহিত করেছে। তবে ইসলামিক স্কলাররা বলেন, নারী যদি নামাজের সময়ের প্রথমভাগে সুন্দরভাবে নামাজ আদায় করে, তাহলে জামাতে নামাজ আদায়ের সওয়াব পাবে। তাই কাজের অজুহাতে বা অলসতা করে মুমিন নারী নামাজ বিলম্বিত বা কাজা করবে না, বরং সময়মতো নামাজ আদায় করবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নারী যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে, রমজানের রোজা রাখে, আব্রু রক্ষা করে, স্বামীর নির্দেশ মান্য করে, তবে জান্নাতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করতে পারবে।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৪১৬৩)

শালীন ও সংযত চলাফেরা : ইসলাম নারী-পুরুষ উভয়কে শালীনভাবে চলার নির্দেশ দিয়েছে। নারী-পুরুষ সবার জন্যই বলা হয়েছে, লজ্জা ঈমানের অঙ্গ। তবে নারীর প্রতি যেহেতু পুরুষের আকর্ষণ অনেক বেশি প্রবল, তাই নারীকে নারীসুলভ সৌন্দর্য প্রদর্শন না করার নির্দেশ দিয়েছে। অশ্লীল পোশাক ও চালচলন পরিহার করতে বলেছে। শুধু ইসলাম নয়, পৃথিবীর সব ধর্মই নারীকে শালীন ও সংযত পোশাক পরিধানের নির্দেশ দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা ঘরে অবস্থান করো এবং জাহেলি (বর্বর) যুগের মতো নিজেদের প্রদর্শন কোরো না।’ (সুরা আহজাব, আয়াত : ৩৩)

নারীর ঘরের বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশ হলো, সে বিনা প্রয়োজনে বাইরে যাবে না। প্রয়োজনে বের হলে শালীন পোশাকে বের হবে এবং সংযতভাবে চলাফেরা করবে। নিজের দৃষ্টি অবনত রাখবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মুমিন পুরুষদের বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং লজ্জাস্থান হেফাজত করে। এটাই তাদের জন্য উত্তম। তারা যা করে নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবগত। মুমিন নারীদের বলে দিন, যেন তারা তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং লজ্জাস্থান হেফাজত করে। সাধারণত যা প্রকাশ পায়, তা ব্যতীত তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। তারা যেন ঘাড় ও বুক মাথার কাপড় দ্বারা ঢেকে রাখে।’ (সুরা : নুর, আয়াত : ৩০-৩১)

জীবনযাপনে অল্পতুষ্টি : অল্পতুষ্টি জীবনে সুখী হওয়ার মূলমন্ত্র। ইসলাম অল্পতুষ্টির শিক্ষা দেয়। ইসলামের শিক্ষা হলো, মানুষ তার ভাগ্যোন্নয়নের চেষ্টা করবে। তবে বর্তমান অবস্থার জন্য হতাশ হবে না, বরং তাকে তাকদির বা আল্লাহর বণ্টন ব্যবস্থার অংশ হিসেবে মেনে নেবে। আরো মন্দ অবস্থা থেকে রক্ষা করায় আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) জাগতিক বিষয়ে নিম্নস্তরের দিকে, পরকালীন বিষয়ে উচ্চস্তরের দিকে তাকিয়ে অনুপ্রাণিত হতে বলেছেন। কিন্তু কোনো কোনো নারী সমাজের অন্যদের সঙ্গে তুলনা করে দুঃখ ও হতাশা প্রকাশ করে।

অনেক সময় তাদের অন্যায় চাহিদা পূরণের জন্য স্বামী সুদ-ঘুষের মতো পাপ কাজে লিপ্ত হয়। ইসলাম এ ক্ষেত্রে নারীকে ধৈর্যশীল হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। পূর্ববর্তী পুণ্যাত্মা মুসলিম নারীগণ স্বামীদের বলতেন, ‘তোমরা হারাম উপার্জন থেকে বেঁচে থাকো। কেননা আমরা ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করতে পারব; কিন্তু জাহান্নামের আগুন সহ্য করতে পারব না।’ (ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিন, বিবাহ অধ্যায়, পৃষ্ঠা ২৩২)

নারীর অল্পতুষ্টির একটি দিক হলো, সামর্থ্য ও চেষ্টার প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করা। মুমিন নারী স্বামীর আন্তরিকতা ও চেষ্টাকে সম্মান করবে। তার প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করবে। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ সেই নারীর প্রতি রহমতের দৃষ্টি দেন না, যে স্বামীর কৃতজ্ঞতা আদায় করে না। অথচ সে তার প্রতি মুখাপেক্ষী।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৯০৮৭)

পারিবারিক সুখ-দুঃখের অংশীদার হওয়া : ইসলাম স্বামী-স্ত্রীকে পরস্পরের পোশাকতুল্য বলেছে, যেন তারা পরস্পরের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়। স্বামীর সংকটে স্ত্রী, স্ত্রীর সংকটে স্বামী পাশে—এটাই ইসলামের নির্দেশনা। এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর প্রথম স্ত্রী খাদিজা (রা.)-কে মৃত্যুর পরও অনেক বেশি স্মরণ করতেন। একদিকে বিয়ের পর খাদিজা (রা.) নিজের সর্বস্ব রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সেবায় উৎসর্গ করেন; অন্যদিকে আল্লাহর রাসুল (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় কাউকে বিয়ে করেননি। মৃত্যুর পর তাঁর সন্তানদের প্রতি পূর্ণ মমতা ও ভালোবাসা বজায় রেখেছেন।

এমনকি খাদিজা (রা.)-কে রাসুলুল্লাহ (সা.) এত বেশি স্মরণ করতেন যে অন্য স্ত্রীরা ঈর্ষাকাতর হতেন। আয়েশা (রা.) একবার ঈর্ষা প্রকাশ করলে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মানুষ যখন আমাকে অস্বীকার করেছিল তখন সে আমার প্রতি ঈমান এনেছে, মানুষ যখন আমাকে মিথ্যাবাদী বলেছে তখন সে আমাকে সত্যাবাদী বলেছে, মানুষ যখন আমাকে সম্পদ থেকে বঞ্চিত করেছে তখন সে আমাকে তার সম্পদ দিয়ে সহযোগিতা করেছে। আল্লাহ তার মাধ্যমে আমাকে সন্তান দান করেছেন।’ (ফাতহুল বারি : ৭/১৭০)