এসপি বিপ্লব কুমারকে মনে রাখবে রংপুরবাসী

| আপডেট :  ৬ নভেম্বর ২০২১, ০৬:৪৫ অপরাহ্ণ | প্রকাশিত :  ৬ নভেম্বর ২০২১, ০৬:৪৫ অপরাহ্ণ

রংপুর জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে ২০১৯ সালের ২৪ জুলাই যোগদান করেন বিপ্লব কুমার সরকার। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে জেলা পুলিশের অনেক কিছুই বদলে যেতে থাকে। জেলা পুলিশের বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন দৃশ্যমান হওয়ার পাশাপাশি মানবিক কাজ করেও কুড়িয়েছেন প্রশংসা। বিশেষ করে করোনা মহামারির শুরুর দিকে তার নিরন্তর প্রচেষ্টা ও মানবিক কর্মযজ্ঞ নাড়া দিয়েছে মানুষের মনকে। জেলার আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি রংপুর জেলা পুলিশকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যেতে বিভিন্ন সৃজনশীল পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

ফেসবুক থেকে নেওয়া দুটি স্ট্যাটাস
ডিআইজি, বাংলাদেশ পুলিশ, রংপুর রেঞ্জ, রংপুরের ফেসবুক পেজে ছবিসহ দেওয়া একটি পোস্টে লেখা রয়েছে,‘তিন অক্ষরের ছোট্ট একটি শব্দ—বিদায়। মাত্র তিন অক্ষর। কিন্তু শব্দটির আপাদমস্তক বিষাদে ভরা। শব্দটা কানে আসতেই মনটা কেন যেন বিষণ্ন হয়ে ওঠে। এমন কেন হয়? কারণ এই যে বিদায় হচ্ছে বিচ্ছেদ। আর প্রত্যেক বিচ্ছেদের মাঝেই নিহিত থাকে নীল কষ্ট। বিদায় জীবনে শুধু একবারই নয়, এক জীবনে মানুষকে সম্মুখীন হতে হয় একাধিক বিদায়ের।’

গত ৩ নভেম্বর ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য্যসহ রংপুর রেঞ্জের কর্মকর্তারা পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার সরকারকে বিদায়ী সংবর্ধনা প্রদান করেন। এর আগে রংপুর জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান থেকে তাকে বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হয়।

রংপুরের মানবাধিকারকর্মী অধ্যক্ষ ফখরুল আনাম বেঞ্জু তার ফেসবুক আইডিতে বিদায় অনুষ্ঠানের বেশ কিছু ছবিসহ একটি পোস্ট দিয়েছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘তিনি আসলেন, সবার হৃদয় জয় করে চলে গেলেন। আমি রংপুর জেলা পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার সরকারের কথা বলছি। বাংলাদেশ পুলিশের আইকন, একজন শিক্ষানুরাগী, জনবান্ধব, সঠিক নেতৃত্বদান, পেশাদারী, সর্বোপরি একজন মানবিক মানুষ। রংপুর আপনাকে মনে রাখবে। সুন্দর হোক আগামীর পথচলা।’

রংপুরের আরেক তরুণ অন্তর রহমান। সমাজ উন্নয়নকর্মী ও জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী হিসেবে বেশ পরিচিত অন্তর রহমানও তার নিজের ফেসবুকে সদ্য বিদায় নেওয়া পুলিশ সুপার সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আপনাকে রংপুর মনে রাখবে কালের সাক্ষী হিসেবে। বিপ্লব কুমার সরকার বাংলাদেশ পুলিশের আইকন। রংপুর জেলার সুযোগ্য পুলিশ সুপার ছিলেন।’

এ রকম অনেকই এসপি বিপ্লব কুমার সরকারের সঙ্গে গড়ে ওঠা সম্পর্ক, ভালোবাসা আর ভালো কাজগুলোকে তুলে ধরে নিজেদের অনুভূতি ফেসবুকে প্রকাশ করেছেন। প্রিয় মানুষটিকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দনবার্তার সঙ্গে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন।

শুক্রবার (৫ নভেম্বর) রাত সোয়া ১২টার দিকে জেলা পুলিশ রংপুর নামের ফেসবুক পেজে বেশ কিছু ছবিসহ একটি স্ট্যাটাস দেওয়া হয়। সেখানে ‘রংপুরের সকল স্তরের মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বিদায় নিলেন এসপি বিপ্লব কুমার সরকার’ শিরোনাম দেওয়া স্ট্যাটাসটিতে লেখা হয়, ‘বিদায় একটি চিরন্তন প্রক্রিয়া। পুলিশের চাকরিতে বদলিও একটি নিয়মিত ঘটনা। কিন্তু কিছু বিদায় থাকে যা সকলের মনে নাড়া দিয়ে যায়। গত দুই বছরেরও অধিক সময় ধরে যে মানুষটি রংপুরের গণমানুষের জন্য দিনরাত কাজ করে গেছেন, তার বিদায়ে সবাই কাঁদবে, এটাই স্বাভাবিক।’

‘রংপুর জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় এসপি বিপ্লব কুমার সরকার সর্বপ্রথম থানায় থানায় অপরাধ সভা করে প্রতিটি থানায় অপরাধের মাত্রা শূন্যের কোঠায় নিয়ে এসেছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ঈর্ষণীয় পরিবর্তন সাধন করেছেন। কার্যকর বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে জনগণের দোরগোড়ায় পুলিশের সেবাকে নিশ্চিত করেছেন। সকল থানাকে দালালমুক্ত করেছেন।’

‘রংপুর জেলা পুলিশ লাইনস, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, পুলিশ হাসপাতাল, পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ সকল স্থাপনায় এনেছেন নানন্দিকতার ছোঁয়া, যা পুরো রংপুরে দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা হিসেবে সকলের প্রশংসা অর্জন করেছে। মানবিক পুলিশ সুপার হিসেবে তিনি সকল সময়ে গরিব, দুঃখী, নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন উদার হস্তে। সকল শ্রেণিপেশার মানুষের জন্য তার দরজা সর্বদা খোলা রেখেছেন। তাই তিনি নায়ক থেকে হয়েছেন মহানায়ক, মানব থেকে হয়েছেন মহামানব ও একজন কর্মবীর।

‘নতুন যাত্রা শুভ হোক। রংপুরের সাধারণ মানুষ ও রংপুর জেলা পুলিশের সদস্যরা বাংলাদেশ পুলিশের আইকন, মানবিক পুলিশ সুপার জনাব বিপ্লব কুমার সরকার, বিপিএম (বার), পিপিএম মহোদয়ের এই অবদান ও ভালোবাসার কথা কোনো দিন ভুলবে না।’

দৃশ্যমান উন্নয়ন ও এসপি বিপ্লব কুমার
বিপ্লব কুমার রংপুর জেলার দায়িত্ব গ্রহণের পর জেলা পুলিশ বিভাগে বেশ কিছু দৃশ্যমান উন্নয়ন করেছেন। যা রংপুরের মানুষের নজর কেড়েছে। এর মধ্যে রংপুর পুলিশ লাইনসের আধুনিকায়ন, সম্প্রসারণ ও দৃষ্টিনন্দন ফটক নির্মাণ অন্যতম। এ ছাড়া পুলিশ লাইনসে আধুনিক মসজিদ নির্মাণ, পুলিশ হাসপাতাল নির্মাণে অগ্রগতি, সাবস্টেশন নির্মাণ, জেনারেটর স্থাপন, পুলিশ লাইনস অডিটরিয়ামের আধুনিকায়ন। পাশাপাশি রংপুর পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজে শহীদ মিনার নির্মাণ, একাডেমিক ভবন সম্প্রসারণ, বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল সংবলিত দৃষ্টিনন্দন ফটক নির্মাণ উল্লেখযোগ্য। পুলিশ সুপার কার্যালয়ে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার স্থাপন তার সময়ে হয়।

একজন মানবিক পুলিশ সুপার
রংপুরে পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদানের পর থেকে পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি যেভাবে মানবিক কাজ করেছেন, তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। অতীতেও অনেক ভালো কাজ হয়েছে। তবে বিপ্লব কুমার সরকারের মতো কেউ সাধারণ মানুষের হৃদয়কে সাড়া ও নাড়া পাননি।

বিপ্লব কুমার সরকার সব সময় নারী ফুটবলারদের পাশে ছিলেন। করোনা মহামারির শুরু থেকে তিনি ছুটেছেন সচেতনতার বার্তা নিয়ে। দরিদ্র ও অভাবী মানুষের জন্য বাড়িয়েছেন সহায়তার হাত। শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, এতিম, দুঃখী, মেধাবী শিক্ষার্থীদের প্রতি ছিল তার সুদৃষ্টি, তাদের মুখে ফুটিয়েছেন হাসি। শিশু-কিশোর থেকে তরুণ-তরুণী, যুব-যুবাদের তিনি ভালো কাজে যেমন উদ্বুদ্ধ করেছেন। তাই তিনি তরুণদের কাছে অনুপ্রেরণা ও আশীর্বাদ।

ভ্যানচালক অসুস্থ বাবার মেয়েকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন বিপ্লব কুমার। বেশ কিছু অসুস্থ, এতিম, অনাথ ও দুস্থ পরিবারের শিশুর চিকিৎসার ব্যয়ভার নিয়েছেন। পবিত্র রমজানে আলুসেদ্ধ খেয়ে রোজা রাখা নুরুন্নবীর জন্য খাবার পাঠিয়েছেন। গোয়ালঘরে থাকা বৃদ্ধা মাকে নতুন ঘর করে দিয়েছেন। খবরের ফেরিওয়ালা শারীরিক প্রতিবন্ধী হকার জাহাঙ্গীরকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, তার সহযোগিতায় করোনাকালে ঢাকা থেকে রংপুরে চলে আসা আলসার রোগে আক্রান্ত রিকশাচালক আলমগীর ফিরে পেয়েছেন হারানো ঘর-সংসার। বৃদ্ধা ফেলানি বেওয়া, নিঃসঙ্গ মহিতনসহ শত শত এতিম শিশু, নিরীহ নুরুন্নবীসহ অসংখ্য মানুষের হাসির নাম যেন বিপ্লব কুমার সরকার। তার মানবিক কাজ ও মানবিকতা, আন্তরিকতা মুগ্ধ করেছে রংপুরের মানুষকে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তার অর্জন
দায়িত্ব গ্রহণের পর বিপ্লব কুমার প্রথমবারের মতো প্রতিটি থানায় গিয়ে অপরাধ প্রতিরোধে করণীয় শীর্ষক মতবিনিময় সভা করেন। ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অভাবনীয় উন্নতি হয়। জনগণ ও পুলিশের মধ্যে সেবার সম্পর্ক গড়তে ছুটেছেন বিভিন্ন স্থানে। কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রমের পাশাপাশি প্রতিটি থানায় বিট পুলিশিং কার্যক্রমে গতিসঞ্চারে ভূমিকা রাখেন। মাদকের বিস্তার রোধে এবং মাদক কারবারিদের ব্যাপারে আইনগত পদক্ষেপ নিতে তার ভূমিকা ছিল জোরালো।

এসপি বিপ্লব কুমার সরকার দায়িত্বে থাকাকালীন রংপুর জেলায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় কমে আসে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, অপহরণ, ধর্ষণসহ হত্যার ঘটনা। অপরাধ দমন ও অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে অনেক সাফল্য রয়েছে জেলা পুলিশের। আলোচিত কলেজছাত্রী রুখিয়া রাউথ হত্যার রহস্য উদঘাটন ও জড়িতদের গ্রেফতার, বিয়ের দিনে কনেকে ছুরিকাঘাত করে হত্যার ঘটনায় আসামিকে গ্রেফতার, নৈশ্যপ্রহরী হত্যার রহস্য উদঘাটন ও অপরাধীদের গ্রেফতার, ছিনতাইয়ের চার ঘণ্টার মধ্যে ইজিবাইক উদ্ধারসহ অনেক ক্লুলেস ঘটনার রহস্য উন্মোচন ও আত্মগোপনে থাকা অপরাধীদের গ্রেফতারে সক্ষম হয় জেলা পুলিশ।

সবশেষ পীরগঞ্জে সাম্প্রদায়িক সহিসংতার ঘটনার অন্যতম হোতাসহ ধর্মীয় উসকানি ছড়ানোর হিন্দু ও মুসলিম দুজন যুবকও গ্রেফতার হয়।

তিনি দায়িত্ব নিয়ে এক টানা চারবার শ্রেষ্ঠ জেলা পুলিশ সুপারের সম্মানে পুরস্কৃত হন। এরপর ভরতে থাকে তার পুরস্কারের ঝুলি। গত ২৮ মাসে রংপুরে তিনি ছয়বার শ্রেষ্ঠত্বের সম্মাননা গ্রহণ করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন থেকে তাকে পদক ও সম্মাননায় ভূষিত করা হয়। বিদায়বেলায়ও তিনি বহু মানুষের ভালোবাসার উপহারে সমাদৃত হন।

উল্লেখ্য, বিপ্লব কুমার সরকার ২০১৩ সালের ৭ এপ্রিল থেকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) হিসেবে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে নিজের দায়িত্ব পালন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখাসহ অপরাধ নিয়ন্ত্রণে অবদান রেখে রেকর্ড সংখ্যক ২৩ বার শ্রেষ্ঠ উপকমিশনার (ডিসি) হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছেন।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও অত্যন্ত সফলতার পরিচয় দিয়ে তেজগাঁও বিভাগ পুলিশকে পরিচালনায় উপকমিশনারের (ডিসি) দায়িত্ব পালন করে প্রায় নিয়মিত শ্রেষ্ঠ ডিসির পুরস্কার জিতেছেন বিপ্লব কুমার সরকার। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি দুবার পুলিশের সর্বোচ্চ পদক বিপিএম ও একবার পিপিএম পেয়েছেন। এর মধ্যে তিনি ২০১৪ সালে পিপিএম, ২০১৬ সালে বিপিএম এবং ২০১৮ সালে তিনি আবারও বিপিএম পদক পেয়েছেন। সূত্রঃ ঢাকা পোস্ট ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন এখানে