নাসির-তামিমার বিয়েতে ভয়ংকর যত জালিয়াতি

| আপডেট :  ৩ অক্টোবর ২০২১, ১১:৫০ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ৩ অক্টোবর ২০২১, ১১:৫০ পূর্বাহ্ণ

একটা সময় ক্রিকেটের মাধ্যমে আলোচনায় ছিলেন জাতীয় দলের ক্রিকেটার নাসির হোসেন। কিন্তু অনেকদিন ধরেই জাতীয় দলের বািরে তিনি। তবে এরপরেও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন তিনি। আর এবার আলোচনার কারণ তামিমা তাম্মিকে বিয়ে। তামিমার প্রথম স্বামী রাকিব হাসানের অভিযোগের প্রেক্ষিতে পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনের তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে নাসির এবং তামিমার বিয়ে সম্পূর্ণ অবৈধ। এই বিয়ের প্রতিটি পদক্ষেপেই করা হয়েছে জালিয়াতি।

রাকিবের সঙ্গে তামিমার পরিচয় ও বিয়ে
পিবিআইর তদন্তে উঠে এসেছে রাকিব হাসান ও তামিমা সুলতানার পরিচয়, প্রেম, বিয়ে ও সংসারের বৃত্তান্ত। ২০১০ সালে ঢাকার উত্তরায় তাদের পরিচয়। গোপনে ২০১০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে প্রথম বিয়ে করেন তারা। ২০১১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাকিব ও তামিমা সুলতানা কাজী অফিসে গিয়ে ৩ লাখ ১ টাকা দেনমোহরে বিয়ে নিবন্ধন করেন। এরপর তামিমাকে তার মা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ানোর কথা বলে বরিশাল থেকে নিয়ে টাঙ্গাইলে আটকে রাখেন। রাকিবকে তালাক দিতে বলেন তিনি। ২০১১ সালের ১৯ এপ্রিল তামিমা সেখান থেকে রাকিবের সঙ্গে পালিয়ে আসেন। এরপর রাকিব তামিমাকে নিয়ে ঢাকার দক্ষিণখানে বাসবাস শুরু করেন। ২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর তারা প্রথম সন্তানের বাবা-মা হন। ওই সময় সন্তানের দেখাশোনার জন্য রাকিব তার শ্বাশুরি ও দুই শ্যালককে ঢাকায় নিয়ে আসেন। ২০১৫ সালের জুলাইতে তামিমা সুলতানা সৌদিয়া এয়ারলাইন্সের কেবিন ক্রু হিসেবে চাকরি পান। সৌদি আরব চলে যান তামিমা। তিন মাস পর ফিরে আসেন। এরপর রাকিব ও তামিমার মধ্যে দেখা দেয় মনোমালিন্য।

ডাক বিভাগের রশিদ জাল
রাকিবকে তালাকের নোটিশ পাঠানোর যে ডাক রেজিস্ট্রি রশিদ বা রিসিপ্ট তামিমার মা সুমি আক্তার উপস্থাপন করেছেন তা জাল বলে প্রমাণ পেয়েছে পিবিআই। টঙ্গী নিশাদনগর পোস্ট অফিসের সাব পোস্টমাস্টার মোহাম্মদ আলী শামিমের জবানবন্দি এবং ডেপুটি পোস্টমাস্টার মোহাম্মদ মাসুদ পারভেজের দেওয়া প্রতিবেদনে এমন কোনও রশিদের সত্যতা পায়নি পিবিআই। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে নিশাদনগর পোস্ট অফিস থেকে রাকিবের গ্রামের বাড়ির ঠিকানায় তালাকের নোটিশ পাঠানোর সত্যতাও পাওয়া যায়নি।

কাজীর অনুপস্থিতিতে নোটিশ লেখেন আরেকজন
তুরাগের হরিরামপুর ইউনিয়নের নিয়োগপ্রাপ্ত নিকাহ রেজিস্ট্রার বা কাজী হলেন খলিলুর রহমান। তার অনুপস্থিতিতে জসিম উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি রাকিব ও তামিমার তালাকের নোটিশ হাতে লিখে তামিমা ও তার মা সুমি আক্তারকে দেন। খলিলুর রহমানের অনুপস্থিতিতে ২০১৭ সালের ২২ এপ্রিল তারিখে রেজিস্ট্রি বইতেও তালাক নথিভুক্ত করেন তিনি। নথি পর্যালোচনায় দেখা যায় রাকিব ও তামিমার বিয়ে তিন লক্ষ এক টাকা দেনমোহরে রেজিস্ট্রি হয়। কিন্তু তালাকের নথিতে দেনমোহরের কলামে দুই লক্ষ টাকা উল্লেখ করেন তারা। এটাও বড় অসঙ্গতি।

বিয়ে ঢাকায়, কাবিননামায় টাঙ্গাইল
মুসলিম বিবাহ ও তালাক নিবন্ধন বিধিমালা ২০০৯-এর ২৫ ধারা মোতাবেক বিয়ে ও তালাক যে স্থানে সম্পন্ন হয়েছে সেই স্থানের নাম উল্লেখ করতে হয়। পিবিআই তদন্তে দাবি করা হয়েছে, নাসির ও তামিমার বিয়ে হয়েছে ঢাকার উত্তরায়। কিন্তু তাদের কাবিননামার ১ নম্বর কলামে ‘বিবাহ কার্যনিস্পন্ন স্থান’-এ ঘারিন্দা ইউনিয়ন কাজী অফিস টাঙ্গাইল সদর উল্লেখ করা হয়েছে। টাঙ্গাইলের ৩ নং ঘারিন্দা ইউনিয়নের নিয়োগপ্রাপ্ত কাজী দেলোয়ার হোসাইন এই বিতর্কিত বিয়েটি নিস্পন্ন করেন বলে পিবিআই তদন্তে পেয়েছে। নাসির হোসেন জবানবন্দিতে জানান, তামিমার সম্পর্কে সব জেনেই বিয়ে করেন তিনি। বিয়ের আগে রাকিবের সঙ্গে তার কখনও দেখা বা কথা হয়নি। তবে ২০২১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি রাকিব হাসানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে একবার কথা হয়।

নাসির-তামিমার ফেসবুকে পরিচয়, রেস্তোরাঁয় সাক্ষাৎ
নাসির হোসেন পিবিআইকে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন, ২০১৬ সালের মাঝামাঝিতে ফেসবুকে তামিমার সঙ্গে তার পরিচয়। প্রায়ই কথা হতো। ২০১৭ সালের ৮ জানুয়ারি তামিমা বাংলাদেশে এলে গুলশান-২ এর একটি রেস্তোরাঁয় তারা দেখা করেন। এরপর নিয়মিতই তাদের কথাবার্তা হতো। একপর্যায়ে একে অপরের প্রেমে পড়েন। বিয়ের আগে তারা বিভিন্ন জায়গায় আরও চার-পাঁচবার দেখা করেন। জানুয়ারিতে পরিচয় হলেও তামিমা ২০১৭ সালের শেষ দিকে রাকিবের সঙ্গে তার বিয়ের বিষয়টি নাসিরকে জানান। বিয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তামিমা অস্বস্তিবোধ করতেন। চেষ্টা করতেন এড়িয়ে যাওয়ার। পরে ২০২০ সালের শেষের দিকে তারা বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। ২০২১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের হাভেলি রেস্তোরাঁয় ২০ লাখ এক শ’ টাকা দেনমোহর ধার্য করে বিয়ে হয় তাদের।

তালাকের নোটিশ দিলেও তামিমা ও তার মা ছিলেন রাকিবের বাসায়
রাকিব হাসান এবং তামিমা সুলতানা ও তার পরিবারসহ ২০১৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৭ সালের জুলাই পর্যন্ত উত্তরার ৯ নং সেক্টরের একাধিক বাসায় একসঙ্গে ছিলেন। ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯ এবং ২০২০ সালে রাকিব তার ভাড়া বাসা, হোটেল ও আত্মীয়-স্বজনের বাসায় স্বামী-স্ত্রী পরিচয় ছিলেন। যদিও তামিমা দাবি করেছেন রাকিবকে তিনি ২০১৬ সালের ডিসেম্বরেই ডিভোর্স দিয়েছেন। পিবিআই’র কাছে তামিমা সুলতানা বলেছেন, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে হোটেল লা মেরিডিয়ানে অনেকবার রাকিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে তার। এ ছাড়াও ২০১৯ সালের ২৪ জুলাই রাকিব হাসান হোটেল লা মেরিডিয়ানের রিজারভেশন রুম নং ১০১৭-তে ‘অ্যাকমপ্যানিং গেস্ট’ হিসেবে তামিমার সঙ্গে একদিন ছিলেন।

স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে রূপার বাসায়
রূপা আক্তার নামে এক নারী পিবিআইয়ের কাছে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরে তার বাসায় তামিমা ও রাকিব হাসান স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে প্রায়ই আসতেন। তামিমা যখন বিদেশ থেকে ঢাকায় আসতেন তখন তারা আমার বাসায় আসতেন। দুই-একদিন থেকে আবার চলে যেতেন। সর্বশেষ ২০২০ সালের ৮ মার্চ তামিমা বিদেশ থেকে আসার পর আমার বাসায় আসেন। রাকিব ও তামিমা স্বামী স্ত্রী হিসেবেই আমার বাসায় ছিলেন এবং ১০ মার্চ তামিমা বিদেশ চলে যান। ২০১৯ সালের দিকে রাকিব তার মেয়েকে শ্বাশুরির কাছ থেকে নিজের কাছে নিয়ে যান। তামিমা ও তার সম্পর্কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করায় রাকিব তার শ্বাশুরিকে উকিল নোটিশও পাঠান।

ডিভোর্সের পরও কাগজপত্রে স্বামী রাকিব
তামিমার পাসপোর্টের মেয়াদ ২০১৮ সালের ৩ মার্চ শেষ হয়। নবায়নের সময় স্বামীর নাম রাকিব হাসানই উল্লেখ করেন তিনি। ২০১৬ সালে ডিভোর্স হয়ে থাকলে স্বামীর নাম রাকিব হাসান লেখার আইনগত বৈধতা নেই বলে জানায় পিবিআই। চাকরির সমস্ত নথি, মেডিক্যাল কার্ড, সৌদি আইডি কার্ড, লাইসেন্স GACA আইডেনটিফিকেশন কার্ড- সবখানে স্বামীর নাম রাকিব হাসান ব্যবহার করছেন। পিবিআইর তদন্তে দাবি করেছে, ‘এসব ঘটনায় স্পষ্ট তামিমা সুলতানা বাস্তবে রাকিবকেই স্বামী মেনে জীবন যাপন করছিল।’

তালাক অবৈধ বলছে পিবিআই
মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ এর ৭(১) ধারা অনুযায়ী তামিমার দেওয়া তালাক কার্যকর হয়নি। এমনকি এ বিষয়ে হাইকোর্টের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনাও অনুসরণ করা হয়নি। পিবিআই তদন্তে নিশ্চিত হয়েছে, ২০১৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর টঙ্গীর নিশাদনগর থেকে রাকিবের ঠিকানায় কোনও তালাকের নোটিশ বা চিঠি রেজিস্ট্রি করে ইস্যু করা হয়নি। এমনকি ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার ১ নং ভৈরবপাশা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন আহম্মেদ পিবিআইকে প্রতিবেদন দিয়ে এ বিষয়ে জানিয়েছেন, ‘তার পরিষদের চিঠি প্রাপ্তি নিবন্ধন বইতে তামিমা সুলতানা কর্তৃক রাকিব হাসানকে তালাকের কোনও নোটিশের চিঠি ২০১৬ সালের ২৩ ডিসেম্বর আসেনি।’
আরও যত প্রমাণ পেয়েছে পিবিআই
তদন্তে নাসির হোসেন, তামিমা সুলতানা ও তার মা সুমি আক্তারের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে পিবিআই। সেগুলো হলো— তামিমা ও তার মা সুমি আক্তার মিথ্যা তালাকের নোটিশ তৈরি করেছেন। এ ছাড়া ডাকবিভাগের চিঠি পাঠানোর ভুয়া রশিদ বানিয়ে সেটাকে আসল বলে ব্যবহার, আগের স্বামী বলবৎ থাকা অবস্থায় মো. নাসির হোসেনকে বিয়ে করে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন, রাকিবের মানহানি করতে সংবাদ সম্মেলন ও এসব কাজে সহযোগিতা করেছেন। নাসির জেনেশুনে রাকিব ও তামিমার বৈবাহিক সম্পর্ক চলমান অবস্থায় তামিমাকে বিয়ে করেছেন। অবৈধ বৈবাহিক সম্পর্ক দেখিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন, বাদীর স্ত্রীকে প্রলুদ্ধ করে নিজের হেফাজতে রেখেছেন নাসির। প্রচারের উদ্দেশ্যে প্রেস কনফারেন্স করে বাদীর স্ত্রীকে নিজের স্ত্রী বলে প্রচার করে বাদী রাকিবের মানহানিও করা হয়েছে। এসব বিষয়ে নাসির ও তামিমাকে সহযোগিতা করেছেন সুমি আক্তার।

রাকিবের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শেখ মিজানুর রহমান আদালতে দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদন বলেছেন, তাদের বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ৪৬৮/৪৭১/৪৯৪/৪৯৭/৪৯৮/৫০০/৩৪ ধারার অপরাধ তদন্তকালীন প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়। ৪৬১ ও ৪৭১ ধারায় জাল জালিয়াতি ও প্রতারণা, ৪৯৪ ধারায় আগের বিয়ে গোপন করে বিয়ে করা, ৪৯৭ ধারায় ব্যাভিচার ও এ কাজে সহযোগিতা করা, ৪৯৮ ধারায় অবৈধ উপায়ে বা ফুসলিয়ে কোনও বিবাহিত নারীকে বিয়ে করা, ৫০০ ধারায় মানহানি করা, ৩৪ ধারায় সংঘবদ্ধ অপরাধের কথা বলা হয়েছে।