নিজের শরীর ও সৌন্দর্যের বিনিময়ে যেভাবে আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রের দেশি এজেন্ট হলেন মর্জিনা

| আপডেট :  ২ অক্টোবর ২০২১, ০১:৩৮ অপরাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২ অক্টোবর ২০২১, ০১:৩৮ অপরাহ্ণ

মর্জিনা আক্তার। কথা বলেন শুদ্ধ ভাষায়। চেহারায় লাবণ্যতা। সহজেই পুরুষদের আকৃষ্ট করতে পারেন তিনি। এক সময় সৌদি আরবে ছিলেন। বিদেশের মাটিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। তারপর ঢাকায় ফিরে পড়েন আর্থিক টানাপড়েনে। হাঁটেন ভিন্নপথে। নিজের শরীর ও সৌন্দর্যের বিনিময়ে অর্থ আয় করেন। সেই মর্জিনা হঠাৎ বনে যান কাস্টমস অফিসার। এই পরিচয়ে ফোনে কথা বলেন। বিদেশ থেকে আসা পণ্য খালাসের নামে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। সর্বস্ব হারিয়ে অনেকেই দ্বারস্থ হয়েছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর। গ্রেপ্তার করা হয়েছে মর্জিনাসহ তিনজনকে। জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে তারা। এমনকি অপরাধ স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন মর্জিনা। ৩০ বছর বয়সী মর্জিনাকে ব্যবহার করতো আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্র। এই চক্রের হোতাদের একজন শহীদুল ইসলাম।

শহীদুলই চক্রের সঙ্গে যুক্ত করে মর্জিনাকে। প্রায় এক বছর আগে মিরপুরে মর্জিনার সঙ্গে পরিচয় তার। খদ্দের হিসেবে তাকে এক ঘণ্টার জন্য ভাড়া করেছিল শহীদুল। তারপর একটি আবাসিক হোটেলে সময় কাটায় তারা। সেখানেই শহীদুল তাকে প্রস্তাব দেয় এই চক্রে জড়িত হওয়ার। শহীদুল জানায়, এভাবে শরীর বিক্রি করে আর কতো টাকা আয় করা যায়। তার চে’ বসে বসে অনেক টাকা আয়ের সুযোগ রয়েছে। কাজটা সহজ। শুধু ফোনে কথা বলা। সব শুনে রাজি মর্জিনা। তারপর প্রশিক্ষণ দেয় শহীদুল নিজেই। প্রথম কাজ দেয়া হয় তাকে, ব্যাংকে কিছু একাউন্ট করাতে হবে। একাউন্ট যাদের নামে হবে তাদের প্রত্যেককে দেড় হাজার করে টাকা দেয়া হবে। একাউন্টের (স্বাক্ষরসহ) চেক বই, পাসওয়ার্ডসহ এটিএম কার্ড সব থাকবে শহীদুলের কাছে। প্রথম এসাইনমেন্টেই সফল মর্জিনা।

ডিম বিক্রেতা সজীব আহমেদ, অটোরিকশাচালক মোহাম্মদ শরীফ হোসেনকে দিয়ে দু’টি একাউন্ট করানো হয়। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, গ্রেপ্তার তিনজন ও মূলহোতা শহীদুলসহ চারজনের নামে দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে ৭০টি একাউন্ট রয়েছে। এসব একাউন্টে লেনদেন হয়েছে কোটি কোটি টাকা। অটোরিকশাচালক মোহাম্মদ শরীফ হোসেনের আটটি ব্যাংকের হিসাবে লেনদেন হয়েছে ২ কোটি ৩০ লাখ ৮ হাজার ২৩ টাকা। ডিম বিক্রেতা সজীব আহমেদের ২২টি একাউন্টে লেনদেন হয়েছে ৩ কোটি ২ লাখ ৪ হাজার ৩শ’ ৪৯ টাকা। শহীদুলের পাঁচটি ব্যাংক হিসাবে লেনদেন হয়েছে ৫ কোটি ২৭ লাখ ৭২ হাজার ৫শ’ ৫০ টাকা।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, ফেসবুক, ফোনে টার্গেটকৃত ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব করে চক্রের সদস্যরা। নিজেকে ভিনদেশি পরিচয় দিয়ে চ্যাট করে। আলাপচারিতায় বুঝিয়ে দেয় নিজের বিপুল অর্থ রয়েছে। কিংবা এমন পরিস্থিতিতে তিনি রয়েছেন এই মুহূর্তে নিজের কাছে বিপুল অর্থ রাখা নিরাপদ না। তা আপাতত বিশ্বস্ত কারও কাছে রাখতে চান। পরে ফিরিয়ে নিবেন। আবার কখনো স্রেফ বন্ধু হিসেবে উপহার পাঠাচ্ছেন বলে জানান। তবে বুঝিয়ে দেন তা অনেক মূল্যবান উপহার।
এসব বিষয় বুঝিয়ে একপর্যায়ে দামি উপহার বা নগদ অর্থ অথবা স্বর্ণ পাঠানোর বিষয়ে অবগত করে চক্রের সদস্যরা। পুরো বিষয়টি ঘটে অনলাইনে যোগাযোগের মাধ্যমে। তারপরই ঘটে মূল ঘটনা।

এরকমই প্রতারণার শিকার সামসাদ বেগম নামে এক নারী মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন, বন্ধুতা করে লন্ডন থেকে উপহার পাঠানো হয়েছে তার কাছে, এমনটি জানানো হয়। ‘ম্যাডাম, শুভেচ্ছা নিবেন। আমি কাস্টমস অফিসার মর্জিনা বলছি। আপনার একটি দামি উপহার এসেছে। বড় এমাউন্টের। এজন্য সোনালী ব্যাংকের সাত মসজিদ রোড শাখায় পৃথকভাবে প্রথমে ৪০ হাজার ২৯ টাকা, পরে ১ লাখ ৫৫ হাজার ১শ’ ১৫ টাকা মিলিয়ে সর্বমোট ১ লাখ ৯৫ হাজার ১শ’ ৪৪ টাকা জমা দিলে ওই উপহারটি আপনার বাসায় পৌঁছে দেয়া হবে।’ এরপর গত ৩রা জুন ব্যাংকে ওই পরিমাণ টাকা জমা দেন সামসাদ বেগম। কিন্তু উপহার আর আসে না। কয়েক দিন পর জানানো হয়, ‘সরি ম্যাডাম। হিসাবে ভুল হয়েছে। আরও ১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা জমা দিতে হবে। কারণ যে উপহার এসেছে তা অনেক মূল্যবান।’ ততক্ষণে সামসাদ বুঝতে পারেন তিনি প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়েছেন। আর টাকা জমা দেননি তিনি।

পরবর্তীতে ওই ফোন নম্বরগুলো বন্ধ পাওয়া যায়। একইভাবে ইংল্যান্ডের আল রায়ান ব্যাংকে মৃত দম্পতির হিসাবে থাকা ২৫ কোটি টাকা পাইয়ে দেওয়ার প্রলোভন দিয়ে ঝিনাইদহের আবুল বাশারের কাছ থেকে ৩ লাখ টাকা লুটে নিয়েছে এই চক্র। এ রকম অভিযোগ অনেক। এই প্রতারক চক্রে দেশি-বিদেশি অপরাধীরা জড়িত। বিদেশিরা চ্যাট করে বন্ধুতা করে। একই কাজ করে শহীদুলও। পরবর্তীতে মর্জিনা কাস্টমস অফিসার সেজে কথা বলেন। ব্যাংকে টাকা আসার পর সেই টাকা উত্তোলন করে শহীদুল ও চক্রের অন্যরা। সেখান থেকে কমিশন পান মর্জিনা।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, বন্ধুতা করে, প্রলোভন দিয়ে উপহার পাঠানোর নামে বিপুল টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই চক্র। ইতিমধ্যে চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। প্রতারণার ঘটনায় রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও তেজগাঁও থানায় দু’টি মামলা হয়েছে। চক্রের অন্যদের গ্রেপ্তার করতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি।

গ্রেপ্তার মর্জিনার বাড়ি ভোলা সদরের শান্তির হাটে। তাকে গত ৩রা সেপ্টেম্বর মিরপুরের কালসির বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। স্বামী ও সন্তান নিয়ে ওই বাসায় থাকতেন মর্জিনা। বাসা থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা জব্দ করা হয়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক নূরে আলম সিদ্দিকী জানান, গ্রেপ্তারের পর একদিনের রিমান্ডে এনে মর্জিনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। রিমান্ড শেষে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন মর্জিনা।