অপকর্মের শেষ নেই চেয়ারম্যান রিয়াজের, সর্বত্রই করেছেন প্রতারণা

| আপডেট :  ২ অক্টোবর ২০২১, ১২:০৮ অপরাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২ অক্টোবর ২০২১, ১২:০৮ অপরাহ্ণ

হত্যাচেষ্টা, বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাঙচুর ও চাঁদাবাজিসহ বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ব্যবহার করেন দুটি করে এনআইডি, টিআইএন নম্বর ও জন্ম তারিখ। সর্বত্রই প্রতারণা করা এই ব্যক্তি বর্তমানে পিরোজপুরের মঠবাড়ীয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান।

২০১৪ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে হলফনামায় নিজেকে স্বশিক্ষিত বলে দাবি করেন। কিন্তু ২০১৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে হলফনামায় নিজেকে এমএসএস পাশ বলে উল্লেখ করেন। অর্থাৎ স্বশিক্ষিত থেকে মাত্র ৫ বছরে তিনি হয়ে যান এমএসএস ডিগ্রিধারী।

এমনকি মনোনয়নপত্রে তার জমা দেয়া জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি), ট্যাক্সপেয়ার্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (টিআইএন) ও আয়করপত্র ছিল ভুয়া। আইন লঙ্ঘন করে তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন ঠিকাদারি কার্যক্রম। উপজেলা পরিষদ ভবন নির্মাণের কাজও করছে তারই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রিয়াজ উদ্দিন এলজিইডির একজন ঠিকাদার। তিনি তার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এথেনা ইন্টারন্যাশনালের লাইসেন্স করার ক্ষেত্রেও ভুয়া এনআইডি নম্বর ব্যবহার করেছেন (নম্বর ৭৯১৫৮৪৯৩৮৭৪৪৫)। মনোনয়নপত্রের হলফনামায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে নিজের অংশীদার ৫০ ভাগ উল্লেখ করেন। কিন্তু উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ার পর স্থানীয় সরকার আইন অমান্য করে ২০১৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর তার একক নামে লাইসেন্স নবায়ন করেন। শুধু তাই নয়, উপজেলা পরিষদ ভবন নির্মাণের কাজও করছে তারই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এথেনা ইন্টারন্যাশনাল।

জানা গেছে, ৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ব্যয়ে মঠবাড়িয়া উপজেলা পরিষদ ভবনের নির্মাণ কাজ চলছে। কাগজপত্রে এ কাজের ঠিকাদার ছিলেন নিয়াজ-রানা (জয়েন্ট ভেঞ্চার)। শুরুতে ওই প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কাজের বিল পরিশোধ করা হতো। সাউথইস্ট ব্যাংক বরিশাল সদর শাখার ওই অ্যাকাউন্ট নম্বর ১১১০০০০০৪৭৮। বিল পরিশোধের পরপরই ওই অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা ট্রান্সফার হয়ে যেত রিয়াজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এথেনা ইন্টারন্যাশনালের অ্যাকাউন্টে।

এথেনার অ্যাকাউন্ট হলো পূবালী ব্যাংক মঠবাড়িয়া শাখায়। যার নম্বর ৪১৭১৯০১০০৬৯০৭। গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নিয়াজ-রানার অ্যাকাউন্ট থেকে ১৯ দফায় এথেনার অ্যাকাউন্টে গেছে ৬৯ লাখ টাকা। এ সংক্রান্ত ব্যাংক স্টেটমেন্ট যুগান্তরের হাতে এসেছে। এদিকে ব্যাংক লেন-দেনের বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর নিয়াজ-রানা থেকে কাজের পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়ে নেয় এথেনা ইন্টারন্যাশনাল। এখন সরাসরি এথেনা ইন্টারন্যাশনালই ওই ভবনের কাজ করছে।

এ বিষয়ে মঠবাড়ীয়া উপজেলা প্রকৌশলী কাজী আবু সাঈদ মো. জসিম বলেন, ‘কাগজপত্র অনুযায়ী জয়েন্ট ভেঞ্চার প্রতিষ্ঠান নিয়াজ-রানা ভবন নির্মাণের কাজ পেলেও ওই দুজনকে আমি কখনও দেখিনি। কাগজপত্রে থাকা বরিশালের একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রথমদিকে বিল পরিশোধ করতাম। পরে নিয়াজ-রানা পুরো কাজের পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়ে দেয় এথেনা ইন্টারন্যাশনালকে। সে অনুযায়ী এখন এথেনাকেই বিল পরিশোধ করা হচ্ছে।’

স্থানীয় সূত্র জানায়, রিয়াজ উদ্দিন ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ভুয়া টিআইএন ও ভুয়া আয়কর প্রত্যয়নপত্র জমা দিয়ে ‘কলার’ ছড়া প্রতীকে নির্বাচন করেন। তবে ওই নির্বাচনে তিনি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। উপজেলা পরিষদের যে নির্বাচনে রিয়াজ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে জয়ী হয়েছেন সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী ছিলেন হোসাইন মোশারেফ সাকু।

রিয়াজের ভুয়া টিআইএন ও আয়কর প্রত্যয়নের বিষয়ে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে পিরোজপুর জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ করে সাকু। এর পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন ২৮ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে পাঠান।

বিষয়টি নিয়ে পিরোজপুর-৩ (মঠবাড়ীয়া) আসনের সংসদ সদস্য ডা. রুস্তম আলী ফরাজী ৭ মার্চ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীনের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি জেলা প্রশাসকের প্রতিবেদন ও সাকুর অভিযোগটি সচিবের হাতে তুলে দেন। সিনিয়র সচিব তাৎক্ষণিকভাবে ওই অভিযোগটি তদন্তের জন্য বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারের কাছে পাঠান।

জানা যায়, রিয়াজ ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা আছে। মঠবাড়ীয়া পৌর শহরে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা লীগ আয়োজিত একটি মিছিলে ২০১৬ সালের ২ ডিসেম্বর অতর্কিত হামলা চালানো হয়। এ সময় বঙ্গবন্ধুর ছবিযুক্ত ব্যানার ছিঁড়ে জনসম্মুখে পদদলিত করা হয়। স্থানীয় সাংবাদিক শাহানা আক্তারের গায়ে হাত তোলা হয়, তার ওড়না ও ক্যামেরা ছিনিয়ে নেয়া হয়। দৈনিক আলোকিত সকাল পত্রিকার সাংবাদিক হেমায়েত খানকে রাস্তায় ফেলে জিআই পাইপ দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হয়। এ ঘটনায় করা মামলার ২ নম্বর আসামি রিয়াজ।

এছাড়া মঠবাড়ীয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি রফিউদ্দীন আহমেদ ফেরদৌসের বাসায় হামলা ও জ্বালাও-পোড়াও মামলার (নং জি.আর ২৩৯/১৬) দুই নম্বর আসামিও রিয়াজ। মামলাটিতে এখনও চার্জশিট দেয়া হয়নি।

মঠবাড়ীয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আজিজুল হক সেলিম মাতুব্বর বলেন, ‘চাঁদার দাবিতে মাস তিনেক আগে আমার ব্যক্তিগত সহকারী ইদ্রিসের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে ঢুকে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় রিয়াজ বাহিনীর সদস্যরা। এ ঘটনায় আহত হন ইদ্রিস। বিষয়টি নিয়ে মঠবাড়ীয়া থানায় মামলা হয়েছে।

তিনি জানান, ২০১৮ সালে দুই লাখ টাকা চাঁদার দাবিতে বরিশাল বিএম কলেজের ছাত্রী ফাতেমা-তুজ-জাহানের স্বামী ডিশ ব্যবসায়ী রাকিবুলকে মঠবাড়ীয়া মাটিয়া মসজিদের সামনে রামদা দিয়ে কুপিয়ে আহত করা হয়। এ ঘটনায় করা মামলার এক নম্বর আসামি রিয়াজ। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তাকে ওই মামলার চার্জশিট থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।

২০১৯ সালের ২২ মার্চ মঠবাড়িয়ার আমতলী বাজারের পাশে ইউনিয়ন তাঁতী লীগ সভাপতি আব্দুল গাফ্ফার আকন ও ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি রাসেলকে কুপিয়ে আহত করে রিয়াজ বাহিনীর সদস্যরা। এর পরদিন নৌকা প্রতীকের উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ প্রায় ২০ সমর্থককে কুপিয়ে আহত করা হয়।

সেলিম মাতুব্বর জানান, মঠবাড়ীয়া উপজেলা এখন মাদকের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। মোবাইলে গোপনে মাদক সেবনের ছবি ধারণ করায় কিছুদিন আগে আল-আমিন নামের এক সৌদি প্রবাসীর হাতের আঙুল কেটে ফেলে রিয়াজ বাহিনীর সদস্যরা।

তিনি বলেন, ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর স্থানীয় সংসদ সদস্য ডা. রুস্তম আলী আলী ফরাজী উপজেলা পরিষদ থেকে বাসায় যাচ্ছিলেন। এ সময় পথে রিয়াজ বাহিনী এমপির গাড়িতে হামলা চালায়। এমপির গাড়িতে থুতু নিক্ষেপ করে রিয়াজ। এ বিষয়ে এমপি ফরাজীর এপিএস আলী রেজা রঞ্জু বাদী হয়ে মঠবাড়িয়া থানায় একটি মামলা করেছেন।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও উপজেলা নির্বাচনে রিয়াজের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হোসাইন মোশারেফ সাকু যুগান্তরকে বলেন, ছয় বছরে রিয়াজ বাহিনীর সদস্যরা শতাধিক হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কুপিয়ে আহত করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেটে নেয়া হয়েছে হাতের কবজি বা আঙুল।

এসব হামলায় আহতদের মধ্যে আছেন- উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক-যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুল আকন, দাউদখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফজলুল হক, মিরুখালী ইউনিয়ন যুবলীগ সদস্য মো. প্রিন্স, একই ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি লাবলু, দাউদখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীর স্ত্রী নারী ইউপি সদস্য খাদিজা বেগম, ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা, ছোট শিংগা গ্রামের শংকর হালদার, চিত্ত রঞ্জন গাইন, চঞ্চল গাইন, স্বপন মিস্ত্রি, বিশ্বজিৎ গাইন, অমৃত গাইন, পারুলি, কৃষক আওয়ামী লীগকর্মী হাসান, হাসানের ভাই নুর মোহাম্মদ, টিকিকাটা ইউপির সদস্য যুবলীগ নেতা ইসমাইল, যুবলীগ নেতা মহিবুল্লাহ, মঠবাড়ীয়া উপজেলা যুবলীগের সহ-সভাপতি কালাম মোল্লা প্রমুখ।

অভিযোগের বিষয়ে রিয়াজ উদ্দিন বলেন, শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়ে ২০১৪ সালের হলফনামায় স্বশিক্ষিত লেখার কারণ হলো-তখন আমার হাতে সার্টিফিকেট ছিল না। আমার সার্টিফিকেট হারিয়ে গিয়েছিল।

তিনি বলেন, আমি যখন মনোনয়ন ফরম পূরণ করি তখন, ট্যাক্স অফিস থেকে একটি প্রত্যয়নপত্র চাই। তারা সেখানে ভুল তথ্য উপস্থাপন করে। আর আমি ভুল করে সেই তথ্যই মনোনয়নপত্রে উপস্থাপন করি। জন্মতারিখের তথ্যটি আমার উকিল ভুল করেছে।

এক প্রশ্নের উত্তরে রিয়াজ বলেন, দায়িত্বে থাকা অবস্থায় অন্যান্য ঠিকাদাররাও ব্যবসা করেন। তাই আমিও করছি। এ কারণেই আমার লাইসেন্স নবায়ন করতে হয়েছে। নিয়াজ-রানার কাছ থেকে এথেনা ইন্টারন্যাশনালের পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নেয়া বেআইনি হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে অন্য যেসব অভিযোগ করা হয়েছে সেগুলো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের কাছ থেকে এসেছে।

এদিকে, দুটি করে এনআইডি, টিআইএন নম্বর ও জন্ম তারিখের কথা নিজেই স্বীকার করেছেন রিয়াজ উদ্দিন আহম্মেদ। এছাড়া শোকজের পরিপ্রেক্ষিতে ২ সেপ্টেম্বর বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারকে তিনি একটি চিঠি দিয়েছেন।

এতে রিয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘মনোনয়নপত্র পূরণের সময় আমি যে টিআইএন নম্বর দিয়েছিলাম সেটি যে ভুল ছিল তা আমার জানা ছিল না। পরবর্তীতে আমি সঠিক টিআইএন নম্বরটি সংগ্রহ করি। মনোনয়নপত্রে দেয়া টিআইএন নম্বরটি (২৮৪০৮৩৮৬৭৫৯৬) সঠিক ছিল না। আমার সঠিক টিআইএন নম্বর হলো ২৮৪০৮৩৮৬৭৫৯৩।’

চিঠিতে রিয়াজ উদ্দিন আরও উল্লেখ করেন, তার প্রকৃত জন্মতারিখ ১৯৭৬ সালের ৩১ মে। এনআইডি নম্বর ৭৯১৫৮১৫৩৮৭৪৪৫। কিন্তু রিটার্ন দাখিলের সময় ভুলবশত জন্মতারিখ ১৯৭৬ সালের ১৩ মে এবং এনআইডি নম্বর ৭৯১৫৮৪৯৩৮৭৪৪৫ লিখা হয়েছে।’

এ বিষয়ে বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার সাইফুল ইসলাম বাদল রোববার বলেন, বিষয়টি নিয়ে তাদের তদন্ত শেষ হয়েছে। এখন প্রতিবেদন লেখার কাজ চলছে। শীঘ্রই এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠাব। মন্ত্রণালয়ই এ বিষয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে।