একজন অবিবাহিত ডিভোর্সী মেয়ের কথা

| আপডেট :  ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৭:২৫ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৭:২৫ পূর্বাহ্ণ

একজন অবিবাহিত ডিভোর্সী মেয়ের গল্পঃ
মধ্য দুপুরে ছুটে চলেছে বাস।
আকাশ নীল। রোদ অনেক।
রোদের উত্তাপ এসে লাগছে কপালে, চোখ খুলা যাচ্ছে না। মেয়েটি বাসের জানালার পাশে বসা। চোখ বন্ধ করে হেড ফোনে গান শুনছে। মুখে মুচকি মুচকি হাসি ভাব। কেমন বিন্দাস ভাব ফুটিয়ে রেখেছে মুখে। বাতাসে মেয়েটির চুল এলোমেলো ভাবে উড়ছে। কেমন মায়া লাগছে দেখতে।

রোদের উত্তাপে কপালটা কুঁচকে রাখছে। কিন্ত জানালার পর্দা টেনে দিচ্ছেনা।
আমিও হেড ফোনে গান শুনছিলাম।
“মনে পড়ে রুবি রায় কবিতায় তোমাকে
এক দিন কত করে ডেকেছি
আজ হায় রুবি রায় ডেকে বলো আমাকে

তোমাকে কোথায় যেন দেখেছি।”
আমার বন্ধু এনাম আমার ভাগ্য দেখে খুব হিংসুটে চেহারা করে রেখেছে। সে আমার পাশে বসতে পারেনি। আলাদা আলাদা সীট পড়েছে আমাদের। শেষ মুহুর্তে টিকেট কাটায় এই অবস্থা।

বন্ধুর পাশের সীটে লং জার্নিতে সুন্দরী তরুনী।
আহ আমার কি কপাল এই হিংসায় মুখ কালো করে রেখেছে এনাম।
যাচ্ছি আমরা দিনাজপুর।
আমার খুব প্রিয় একটা শহর। আগেও কয়েকবার গিয়েছি। দিনাজপুরের মানুষ আমার দেখা খুব সরল, এত সহজ ও আন্তরিক, অতিথিপরায়ন যা আমাকে বারবার দিনাজপুর যেতে আগ্রহী করে তুলে।

আমার একজন প্রিয়বন্ধু রুলির আমন্ত্রন অনেক দিন উপেক্ষা করে ছিলাম, এইবার নিজের মনই চাইলো একটু ঘুরে আসতে, দিনাজপুরের রামসাগর আমার প্রিয় জায়গা।
রামসাগর এর পাড়ে আমি নীরবে বসে গান শুনি আর শান্ত, স্থির সাগর এর মত দিঘীর টলমলে নীল জলরাশির দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকি। শীতকালে এখানে প্রচুর জলজ অতিথি পাখি আসে, যাদের খুনসুটি মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। সবুজ গাছে পাখিদের কলকাকলি ও কিচিরমিচিরে আপনার অশান্ত প্রাণ শান্ত হয়ে যাবে।

রামসাগর এর ইতিহাসে জড়িয়ে আছে দয়ালু রাজা প্রাননাথ উনার একমাত্র পুত্র রামকে এই দিঘীতে বলি দিয়েছিলেন ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দে এর দিকে প্রচন্ড খরায় যখন হাজার হাজার প্রজা পানির অভাবে মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে, তখন স্বপ্নাদেশে রাজা একটি পুকুর খনন করেন। কিন্ত সেই পুকুর থেকে পানি না উঠায় স্বপ্নে দৈববাণী পেলেন তাঁর এক মাত্র ছেলে রাম কে দিঘীতে বলি দিলে পানি উঠবে। দয়ালু রাজা প্রজাদের জীবন বাঁচাতে নিজের একমাত্র পুত্রকে দিঘীর জলে হারিয়ে যেতে দিলেন।
রাজা প্রাননাথের সেই দিনের সেই ক্ষনের মনের অবস্থা ভেবে মনটা ব্যাকুল হয়ে গেলো।

লং জার্নিতে বই থাকবেনা সাথে তা হতে পারেনা। সাথে ছিল আহমদ ছফার প্রথম উপন্যাস সূর্য তুমি সাথী। আমি অবাক বিস্ময়ে ভাবি ২১-২২ বছর বয়সে একজন লেখক এমন উপন্যাস কিভাবে লিখেছেন। এখানেই ছফার জাদুকরী প্রতিভা।
সূর্যের আলো যতক্ষন সাথী ছিল বইটা তে ডুবে ছিলাম, কখন যে বাসে ঘুমিয়ে পড়লাম টের পাইনি।

জেগে দেখি মায়বী বিকেলে রক্তিম সূর্য। তেজ নেই শান্ত।আমার বন্ধু এনাম ঘুমের দেশে। বাস চলছে দুরন্ত গতিতে, জীবন চলছে জীবনের গতিতে।
পাশে বসা মেয়েটির দিকে তাকালাম।
উনি একটা মিষ্টি হাসি দিলেন।
আমি নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম, দিনাজপুর যাচ্ছি, আপনি কোথায় যাবেন?
উনি বললেন, আমিও দিনাজপুরই যাচ্ছি। ইনফ্যাক্ট আর কোথায়ও যাবার যায়গাও আমার নেই।

কথাটার মধ্যে কেমন একটা বিষাদ এর সুর শুনতে পেলাম।

পথে অনেক গল্প। মজাদার সব আলাপ। দিনাজপুর এর স্মৃতি রোমন্থন হয়ে গেলো সেখানে না পৌঁছার আগেই।

মেয়েটার মাঝে কোন জড়তা নেই, সহজেই একদম অপরিচিত কারো সাথে মিশে যাবার চমৎকার গুন দেখলাম তার মাঝে।

রাত ১০ টায় আমরা দিনাজপুর শহরে পৌঁছলাম।
বাস থেকে নেমে আমার বন্ধু রুলিকে দেখে প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। কতদিন পর দুই বন্ধুর দেখা, সে এখন এক বাচ্চার মা।

আমি রুলির সাথে কথা বলছিলাম, রুলির চোখমুখ খুশিতে চিকচিক করছিল, তখন একজন বললো, এক্সিউজ মি, ১০ ঘন্টা আমরা একসাথে জার্নি করে আসলাম, আমার শহরে এসেছেন এত দূরে, আগামীকাল বিকেল ৪টায় আড্ডায় গোধূলীতে এক কাফ কফি খেলে খুশি হবো।

আমি স্মৃত হেসে রুলির দিকে তাকালাম।
তারপর মেয়েটি বললো, আমি ডালিয়া, একজন ডিভোর্সী, তবে অবিবাহিত।
তারপর বললো, কিছুটা রহস্যে থাকুক আজ।
দেখা হবে আশা রাখলাম। আসবেন কিন্ত।

আমি রুলিকে বললাম, অবিবাহিত ডিভোর্সী! কাহিনী কিছু তো বুঝলাম না। রুলি খোঁচা মেরে বললো, সুন্দর কিন্ত মেয়েটি।

আমরা উঠলাম মালদাহ পট্টির হোটেল ডায়মন্ডে।
হোটেলে উঠে ফ্রেশ হয়ে গেলাম রুলির বাসায় ডিনারে।
সে অনেক করে বললো, তার বাসায় থাকতে, আমি রাজি হলাম না।

পরদিন সকালে আমরা গেলাম আমার প্রিয়স্থান রামসাগর এর পাড়ে। অনেক দিন পর শান্ত দিঘীটার নীল জল আমাকে আনমনা করে দিলো।

দুপুরে রুলির জামাই মার্টিন চাইনিজে আমাদের ট্রিট দিলেন।
তারপর গেলাম কান্তজীর মন্দিরে। মাথায় ঘুরছে আড্ডায় গোধুলী, অবিবাহিত ডিভোর্সীর রহস্যে জানার ব্যাকুলতা।
এনাম খুব খোঁচাচ্ছিল। সাথে রুলি যোগ দিল।

আড্ডায় গোধূলি, দিনাজপুর এর একটা বিখ্যাত কফিশপ।

আমি রুলি এনাম ও আমাদের হোস্ট ডালিয়া।
ডালিয়া ও আমি মুখোমুখি বসেছি।
মেয়েটার চেহারায় একটা অদ্ভুত দ্যুতি আছে।
রুলি খোঁজ নিলো বাসা কই, বাসায় কে কে আছে।

ডালিয়া ও তার টিনেজ দুই ভাই বোন নিয়ে তার সংসার।
বাবা মারা গেছেন যখন সে ক্লাস এইটে পড়ে। তারপর আত্মীয়রা মিলে চাচার কাছে মাকে বিয়ে দেয়।
চাচা হয়ে গেলো বাবা। চাচার ঘরে মা এর দুই ভাই।
রহস্যময় কারণে চাচা তাদের নিয়ে মা এর সাথে অশান্তি শুরু করলো।

যখন সে কলেজে পড়ে তখন ডালিয়ার চাচা ভাই এর তিন বাচ্চাকে প্রচন্ড হিংসে শুরু করলো। আর এই হিংসেটা বেড়ে গেলো ডালিয়া যখন টেনে খানসামা উপজেলার কোন এক গ্রামের এক স্কুল থেকে একমাত্র মেয়ে যে কমার্স থেকে এ প্লাস পেয়ে যায়।

মায়ের সংসারে অশান্তি। দাদা দাদী নেই, নানা নানী নেই। মামারা খেয়াল রাখেনা। খালা ঢাকায় থাকে। বাবা চাচা দুই ভাই ছিল। ফুফু নেই। বাবা মারা যাওয়ায় চাচা ই সব সম্পত্তির মালিক।

চাচার অত্যাচার চরমে। মা দিশেহারা।
একটা ১৭ বছর এর মেয়ে ছোট দুই ভাই বোন নিয়ে সাথে ১৫০০০/ টাকা নিয়ে বাড়ি ছেড়ে দিল।

দিনাজপুর শহরে চলে আসলো।
ডালিয়ার স্কুলের এক ম্যাডাম এর ভাই তাকে দুইটা টিউশনি ঠিক করে দেয়। এক রুমের বাসা নিয়ে সেই শহর জীবন শুরু তাদের।
একটা জীবন যুদ্ধ।

আমাদের জীবন ও অভাবের দিন গুলিতে বিষাদ নদী ছিল। তাই মেয়েটার বিষাদ নদীর তলটা আমি স্পর্শ৷ করতে পারছিলাম।

১৭ বছরের মেয়ের মেন্টাল স্ট্যামিনা ও সাহস এর কথা ভেবে আমি অবাক হয়ে গেলাম।

বারটা বছর সে যুদ্ধ করে এখন জয়ী জীবনের নিষ্ঠুর যুদ্ধে। এখন ডালিয়া ২৯ বছর এর তরুনী। একজন ব্যাংকার।

দুই ভাই বোন মাস্টার্স এ পড়ে। ডালিয়ার স্বপ্ন দুই ভাই বোন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।

বিয়ে করবেন না জানতে চাইলাম।
একটা অট্ট হাসি দিয়ে বললে। আমার মা বিয়ে করেছিল তো দুইবার।
তাই আমার আর ইচ্ছে নেই।

ইনফ্যাক্ট আমি তো ডিভোর্সী। অবিবাহিত ডিভোর্সী।

আমি বললাম, বুঝলাম না।

জীবন থেকে স্নেহ, মায়া, ভালবাসা, আদর, সুখ, ভালো খাবার, ভালো জামা জুতা, স্বাদ, আহ্লাদ, শখ, একমাত্র বাবা তুল্য চাচার হাতের থাপ্পড়, গালিগালাজ, অভব্য আচরন, সব কিছুকেই তো ডিভোর্স দিয়ে আজ এখানে এসেছি। অন্ধকার সময়ে এখন আলোতে ভরপুর।

তাই আর বিয়ে নয়। ভাই বোন দুটোর সুখই আমার সুখ।

মা এর সাথে যোগাযোগ আছে?
জানতে চাইলাম।
বললো, মা সুখে আছেন। প্রথম প্রথম অনেক ফোন দিতেন, আমি ধরতাম না। খুব কাঁদতাম।
এখন তো অভ্যাস হয়ে গেছে।

আপনাদের দেখতে আসেনা?
না, আসতে চায়, চাচা আসতে দেয়না। এখন মায়েরও অভ্যাস হয়ে গেছে।

বারো বছর বাড়ি যাইনা। মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে বাবার কবর এর কাছে গিয়ে চিৎকার দিয়ে কাঁদি। কিন্ত যাইনা।
আমাদের তিনজনের চোখ ঝাপসা।

কফিটা ঠান্ডা হয়ে গেছে আপনার।
ডালিয়া বললো।

আমি নিশ্চুপ হয়ে মুক হয়ে রইলাম।
যখন হোটেল ডায়ন্ডমে ফিরে এলাম, একটা মায়াবী আবেশ রয়ে গেলো।
এমন সাহসী জীবন যেই তরুণীর, সেই তরুণীর মুখোমুখি হবার ইচ্ছে আরো একবার।
খুশিতেও কারো কারো মন খারাপ হয়।
আজ আমার খুশিতে মন খারাপ।

ডাঃ জোবায়ের আহমেদ।