ইভানাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে সহকর্মী ‘প্রেমিকা’র সঙ্গে কথা বলতেন রুম্মান

| আপডেট :  ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৯:০৬ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৯:০৬ পূর্বাহ্ণ

ইংরেজি মাধ্যম স্কুল স্কলাসটিকার ক্যারিয়ার গাইডেন্স কাউন্সিলর ইভানা লায়লা চৌধুরীকে (৩২) তার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, ইভানাকে তার স্বামী প্রতিদিন একটি করে ঘুমের ওষুধ খাওয়াতেন। কারণ, সেই ওষুধ খেয়ে ইভানা ঘুমিয়ে গেলে স্বামী আব্দুল্লাহ মাহমুদ হাসান রুম্মান কথিত প্রেমিকার (সহকর্মী ব্যারিস্টার) সঙ্গে কথা বলতেন।

এক বছর ধরে বয়ে চলা মানসিক যন্ত্রণা, ডিভোর্সের হুমকি, স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের নির্যাতনের পাশাপাশি ঘুমের ওষুধ ইভানাকে আত্মহত্যার মতো বাড়াবাড়ি পর্যায়ে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেছেন তার বাবা এ এসএম আমান উল্লাহ চৌধুরী। শনিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সারাবাংলার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য।

অনুসন্ধানকালে ইভানার পাঠানো একটি ই-মেইল, বান্ধবীর সঙ্গে ফেসবুক মেসেঞ্জারে চ্যাটিংয়ের কপি এবং তার স্বামী আব্দুল্লাহ মাহমুদ হাসান ওরফে রুম্মানের সঙ্গে প্রেমিকার কথোপকথনের কপি সারাবাংলার হাতে এসেছে। এছাড়া ইভানার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেও তাকে নিয়মিক ঘুমের ওষুধ খাওয়ানোর অভিযোগের কথা জানা গেছে। স্বামী রুম্মানের পরকীয়া জানার পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন ইভানা।

এক পর্যায়ে শারীরিকভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের অবহেলা-নির্যাতন ইভানাকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করেছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। ফেসবুক মেসেঞ্জারে ইভানা তার বান্ধবীর সঙ্গে চ্যাটিংয়ে বলেছেন, ‘এক মাস হলো আমি শারীরিকভাবে ভালো নেই। রুম্মান প্রতিদিন আমাকে ঘুমের ওষুধ খাওয়ায়। ওপরে দেখায় সে আমাকে কেয়ার করছে।

কিন্তু সে মূলত তার প্রেমিকার সাথে কথা বলার জন্যই আমাকে ঘুমের ওষুধ দেয়।’ ইভানা লিখেন, ‘আনুমানিক এক বছর ধরে রুম্মান আমাকে এড়িয়ে চলে। গত বছরের ৫ আগস্ট আমি প্রথম তার সাথে প্রেমিকার কথোপকথনের মেসেজ দেখতে পাই। এটা দেখার পর সে আমার ওপর সব দোষ চাপায়। আর সে কারণে আমাদের বিয়েটারও সমাপ্তি ঘটাতে চায়।’ গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর ইভানা দেখতে পান, তার স্বামী প্রতিদিন সকাল সাড়ে আটটায় প্রেমিকার রোমান্টিক মেসেজ পেয়ে ঘুম থেকে ওঠে।

জানা যায়, এসব বিষয়ে রুম্মানের সঙ্গে কথা বলতে গেলে নানাভাবে গালিগালাজ করা হতো তাকে। এমনকি গায়ে হাত পর্যন্ত তুলতো রুম্মান। আর কথায় কথায় ডিভোর্সের বিষয়টি বলতো। গত ৩ মে ইভানা তার একজন সহকর্মীকে ই-মেইলে বার্তায় বলেন, ‘আমার দুই ছেলে সন্তান রয়েছে। ছোট ছেলেটি অটিজমের শিকার। এবার তার স্কুল শুরু হবে। আমি যেন তাকে ভালোভাবে সময় দিতে পারি সেজন্য আমাকে চাকরিটা ছাড়ার জন্য চাপ দিচ্ছে রুম্মান। তাছাড়া এটা-ওটা নিয়ে রুম্মান সম্প্রতি আমাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে।

সে বলে, আমাদের টাকার অভাব নেই। তোমাকে চাকরিটা ছাড়তে হবে এবং কোনো ধরনের যোগাযোগ করা যাবে না। কীভাবে, কী করব এবং ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে বাচ্চাদের নিয়ে কীভাবে জীবন কাটাব, সবকিছুর পরামর্শের জন্য স্যার আপনার কাছে সহযোগিতা ও পরামর্শ চাই। অথবা সাক্ষাৎ না পেলে এ সংক্রান্ত কিছু লিংক বা কোনো বই দেবেন, যেগুলো পড়ে আমি উপকৃত হব। আর রুম্মানের সঙ্গে একান্তই যদি আমার ডিভোর্স হয়ে যায় তাহলে অন্তত ৩০ হাজার টাকার দরকার পড়বে প্রতি মাসে। যা দিয়ে দুই সন্তানসহ চলা সম্ভব হবে।’

অনুসন্ধানের সময় জানা যায়, ইভানা নিজে এবং সন্তানদের বাঁচাতে নানাভাবে নানাজনের কাছে সহযোগিতা ও পরামর্শ চেয়েছেন। তার মানে ইভানা প্রতিনিয়ত লড়াই করে গেছেন। একদিকে ওষুধের প্রভাব, অন্যদিকে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের অত্যাচারে মানসিক ও শারীরিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন ইভানা। প্রতিদিন রুম্মান ও তার প্রেমিকার কথোপকথন, মেসেজ, স্বামীর এড়িয়ে চলা এবং বারবার ডিভোর্সের হুমকি দেওয়া মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি। সবকিছু মিলে ইভানা আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হন বলে জানায় ইভানার পরিবারের লোকজন।

এমনকি যেদিন (১৫ সেপ্টেম্বর) ইভানা ৯ তলার ছাদ থেকে লাফ দেয় সেদিনও ঘটে নানা কাহিনী। সেদিন সকালে রুম্মান ও তার বাবা-মা ইভানাকে বকাঝকা করে। ওই সময় তারা বলে যে, মারা যাওয়া কি এত সোজা? তারা ইভানাকে আরও কটূ কথা বলে উত্তেজিত করে তোলে। পরে ইভানা ফোনে কথা বলতে বলতে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।

তার আগে, গত ১৩ সেপ্টেম্বর রুম্মানের আচরণে মানসিকভাবে আঘাত পেয়ে হাতের রগ কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা চালায় ইভানা। এমনকি সেই ঘটনার কথা ভিডিও কল করে জানায় বাবাকে। ওই রাতে ইভানার বোন ফারহানা বারবার কল করে তাকে। কিন্তু ইভানা ফোন ধরে না। এক পর্যায়ে রুম্মান কল রিসিভ করে বলে, ‘ইভানা ওভারডোজ ওষুধ খেয়ে ঘুমাচ্ছে।’

১৪ সেপ্টেম্বর দুপুরে ফারহানা আবারও কল করে ইভানাকে। না পেয়ে ইভানার শাশুড়িকে কল করলে তিনি বিরক্ত হন। তিনি ভীষণ বিরক্ত হয়ে ফারহানাকে বলেন, ‘কেন আমাদের বাসায় আসছো।’ জবাবে ফারহানা জানায়, ইভানা যেহেতু ওভারডোজ ওষুধ খেয়ে ঘুমাচ্ছে তাই দেখা করতে যাচ্ছি। এরপর ফারহানা রুম্মানদের বাসার নিচে পার্কিংয়ে গিয়েও ফেরত আসেন। কারণ, ইভানা তাকে বাসায় ঢুকতে নিষেধ করেন।

জানা গেছে, শাশুড়ির চাপে ইভানা তার বোন ফারহানাকে ঢুকতে দেয়নি। বিকেলের দিকে ইভানা ভিডিও কল করে কান্নাকাটি করতে থাকে। ফারহানাকে বলেন, ‘রুম্মান কেন আমাকে আর পছন্দ করছে না? কেন অন্যকে ভালোবাসে?’ রাত সাড়ে ৯ টায় ফারহানা তার বোন ইভানাকে ফোন করলে আবারও রুম্মান কল রিসিভ করে বলে, ‘ইভানা ঠিক আছে এবং ঘুমিয়ে পড়েছে।’

এরপর ১৫ সেপ্টেম্বর রুম্মানের বাবা ইভানার বাবাকে ফোন করে বলেন, ‘রুম্মান ও ইভানার মধ্যে একটা সমস্যা হয়েছে।’ এই কথা বলে বাবা ও বোন ফারহানাকে তাদের বাসায় ডেকে নেন। তারা সেই বাসায় গিয়ে দেখেন যে, দুই ভবনের ফাঁকে ইভানার মৃতদেহ পড়ে আছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইভানার বাবা আমান উল্লাহ চৌধুরী আক্ষেপ করে সারাবাংলাকে বলেন, “ইভানা এলএলবি ডিগ্রি অর্জনের পর ‘ব্যারিস্টার অ্যাট ল’ করার অফার পেলেও রুম্মান তাকে নিরুৎসাহিত করে। পরেও তার ইভানাকে ‘ব্যারিস্টার অ্যাট ল’ করতে দেয়নি। এমনকি স্কলাসটিকার চাকরিটাও ছেড়ে দিতে চাপ দেয়। এক পর্যায়ে ইভানা সন্তানদের জন্য ফুল টাইম চাকরি ছেড়ে পার্ট টাইম জব শুরু করে।”

ইভানার বোন ফারহানা সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইভানা বিয়ের কিছু দিনের মধ্যেই জানতে পারে, তার স্বামীর চরিত্র খারাপ। সে বিভিন্ন নারীর সঙ্গে পরকীয়ায় আসক্ত। এ নিয়ে তাদের ঝগড়া-বিবাদও হতো। রুম্মান ইভানার গায়ে হাতও তুলতো। প্রায় বছর খানেক হলো ইভানা জানতে পারে, রুম্মান আরেকজন বিবাহিত ব্যারিস্টারের সঙ্গে প্রেম করছেন। জানা গেছে, তার স্বামীও একজন ব্যারিস্টার। ইভানা নিজেই রুম্মানের ফোনে ও হোয়াটসঅ্যাপে ওই নারীর সঙ্গে প্রেমালাপের প্রমাণ পায়।’

ফারহানা বলেন, ‘নানা কারণ দেখিয়ে ইভানার ওপর অত্যাচার করা হয়েছে। শ্বশুরবাড়ির কেউ তার ফেভারে ছিল না। তাকে মরতে বাধ্য করা হয়েছে। আমরা রুম্মানসহ জড়িতদের বিচার দাবি করছি।’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মওদুত হাওলাদার বলেন, ‘ইভানার বাবার দেওয়া কোনো অভিযোগ এখনও পাইনি। অভিযোগ দিতেই পারেন পিতা হিসেবে।

আরও কেউ অভিযোগ করতে পারেন। অভিযোগে কী লিখেছেন তা দেখে, সবকিছু আমলে নিয়ে আমরা তদন্ত করব। যদিও ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু হয়েছে। কেউ জড়িত থাকলে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।’ উল্লেখ্য, বুধবার (১৫ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা ৬ টার দিকে রাজধানীর শাহবাগ থানার নবাব হাবিবুল্লাহ রোডে (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের পেছনে) দুটি ভবনের মাঝখান থেকে ইভানা লায়লা চৌধুরীর মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই দিন থেকেই ইভানার মৃত্যু নিয়ে রহস্য দেখা দিয়েছে।

তার স্বামী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ মাহমুদ হাসান ওরফে রুম্মানের আচরণ সন্দেহজনক। ঘটনার দিন রুম্মান কিংবা তার বাড়ির লোকজন কেউ সহযোগিতা করেনি। এমনকি ইভানা মর্গে থাকলেও তাদের কেউ হাসপাতালে যাননি। এরপর ১৬ ও ১৭ সেপ্টেম্বর ইভানার মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে সরেজমিনে অনুসন্ধান করে সারাবাংলা ডটনেটের এই প্রতিবেদক। অনুসন্ধানে ইভানার মৃত্যু নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করে।