শহরের উজ্জ্বল আলোর নিচে অন্ধকারে ওত পেতে থাকে হায়েনারা!

| আপডেট :  ১২ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১০:১১ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ১২ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১০:১১ পূর্বাহ্ণ

অভাবের তাড়নায় কাজের খোঁজে গ্রাম থেকে রাজধানীতে এসেছিলেন স্বামী পরিত্যক্তা শিউলি বেগম। যাত্রাবাড়ী এলাকায় যেচে পরিচিত হন এক ব্যক্তি। তিনি চাকরির প্রলোভন দেখান। গ্রামের সহজ-সরল নারী কী করে জানবেন শহরের উজ্জ্বল আলোর নিচে অন্ধকারে ওত পেতে থাকে নারী পা’চারকারী হায়েনারা! সরল বিশ্বাসে শিউলি লোকটির সঙ্গে যান। তারপর যাত্রাবাড়ীর শহীদ সরণি রোডের সামিউল্লাহ প্লাজায় অবস্থিত প্রভাতি আবাসিক হোটেলে শিউলির জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। দুই মাসের বেশি সময় ধরে শিউলিকে বদ্ধ কক্ষে জো’র করে আ’টকে রেখে দেহ ব্যবসায় নামতে বা’ধ্য করা হয়। এখানেই শেষ নয়, কিছুদিন পর সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে শিউলিকে পা’চার করে দেওয়া হয় ভারতে।

পা’চারের ছয় মাস পর পা’লিয়ে দেশে ফিরতে পেরেছেন শিউলি। কিন্তু আর স্বাভাবিক হতে পারেননি তিনি। সারাক্ষণ তাঁকে তাড়া করে ঢাকার যাত্রাবাড়ী ও ভারতের হায়দরাবাদে কা’টানো বিভীষিকাময় জীবনের ভ’য়ংকর অধ্যায়। অনেক চেষ্টার পর কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানী দল শিউলির সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়। এরপর শিউলি তুলে ধরেন তাঁর পা’চার সময়ের বিভিন্ন ঘটনা।

শিউলি বলেন, ‘তিন বছর আগে স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয় আমার। এরপর ছোট ছোট দুই মেয়েকে নিয়ে অথই সাগরে পড়ি। দুই বেলা খাওয়াতেও পারতাম না। বা’ধ্য হয়ে চাকরির আশায় ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে চলে আসি। সেখানে এক লোকের সঙ্গে পরিচয় হয় আমার। তিনি আমাকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে একটি হোটেলে নিয়ে যান। কিন্তু সেখানে নেওয়ার পর আমার মোবাইল এবং অন্যান্য জিনিসপত্র কেড়ে নিয়ে আমাকে আ’টকে রাখা হয়। এক পর্যায়ে জো’র করে দেহ ব্যবসায় নামতে বা’ধ্য করে আমাকে। এসব কাজ করতে রাজি না হলে নেমে আসত অসহনীয় অ’ত্যাচার। পরে হোটেল মালিক শিশির ও সাজ্জাদ নামের দুই ব্যক্তি আমাকে ভারতে পা’চার করে দেয়।’

শিউলি বলেন, ‘আমিসহ মোট আটজন নারীকে সাতক্ষীরা দিয়ে রাতের আঁধারে বর্ডার পার করে হায়দরাবাদে পাঠায় মানবপা’চারকারীরা। সেখানে একটি বাড়িতে আ’টকে রাখা হয় আমাদের। ওই বাড়িতে আরো কয়েকজন ত’রুণীর সঙ্গে পরিচয় হয় আমাদের। তাদের মধ্যে কয়েকজন বাংলাদেশিও ছিল। আমাদের মতো তারাও দালালের মাধ্যমে পা’চারের শি’কার হয়। ওই বাড়িতে পা’চারকারীচ’ক্রের সদস্যদের কাছে কয়েকবার ধ”ণের শি’কার হতে হয়েছে। এর কয়েক দিন পরই আমাদের বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। হোটেলগুলোতে এক দিনে কয়েকজনের ধ”ণের শি’কার হতে হতো। এসব ঘটনার প্র’তিবাদ করলে নেমে আসত ভ’য়ংকর নি’র্যাতন। ওখানে যেহেতু আমাদের পাসপোর্ট ছিল না, পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার ভ’য় দেখিয়ে এবং ব্ল্যা’কমেইল করে দেহ ব্যবসা চা’লিয়ে যেতে বা’ধ্য করা হতো।’

শিউলি বলেন, ‘এভাবেই কে’টে যায় প্রায় ছয় মাস। যখন স্বাভাবিক জীবনে ফেরার স্বপ্ন বাদ দিয়েছি, তখনই দেখতে পাই আশার আলো। ভারতীয় এক খদ্দের আমাদের ক’ষ্টের কথা শুনে সাহায্য করতে রাজি হন। পরে তাঁর সহায়তায় আমরা আট নারী একইভাবে রাতের আঁধারে সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে চলে আসি। দেশে আসার পর এখনো আমরা ভ’য়ে পা’লিয়ে থাকি। যাত্রাবাড়ী এলাকার দিকে কখনোই আর আসি না।’

শুধু প্রভাতি আবাসিক হোটেলই নয়, যাত্রাবাড়ী এলাকার অনেক আবাসিক হোটেলই নারীপা’চারের সঙ্গে জ’ড়িত। সেগুলোর একটি শহীদ ফারুক রোডের চৌরাস্তায় হাজি ইউনুস মার্কে’টের চতুর্থ তলার পপুলার আবাসিক হোটেল। এখানেও চাকরিপ্রার্থী অ’সহায় নারীদের জো’র করে আ’টকে রাখার অ’ভিযোগ রয়েছে।

গত ২ জুন পপুলার হোটেলে অ’ভিযান চা’লিয়ে দেহ ব্যবসার অ’ভিযোগে কয়েকজন নারী ও পা’চারকারীচ’ক্রের কয়েকজন সদস্যকে আ’টক করে র‌্যা’ব। অ’ভিযানে আ’টক মো. অলিউল্লাহ, মো. আকাশ খান ও মো. শরীফ হোসেন প্রাথমিক জি’জ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেন তাঁরা কাজের প্রলোভন দেখিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নারীদের এনে জো’রপূর্বক প’তিতাবৃত্তিতে বা’ধ্য করতেন।

কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধান মতে, গত ১৫ বছরে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে শিউলির মতোই হাজারো অ’সহায় নারীকে দেহ ব্যবসায় বা’ধ্য করার পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশ ভারতে পা’চার করেছে বিভিন্ন হোটেল কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি সরেজমিন হোটেল প্রভাতিতে গিয়ে কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানী দলও অ’পরাধের প্রমাণ পায়। সাথি (ছদ্মনাম) নামের একজন নারীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হলে তিনি হোটেল ব্যবসার আড়ালে মালিকের নোং’রা ব্যবসার ফাঁ’দের গল্প তুলে ধরেন। তিনি বারবার বলছিলেন, ‘আমাকে যেভাবেই হোক বের করার ব্যবস্থা করুন।’

ওই নারী বলেন, ‘আমি কাজের জন্য আসছিলাম। অফিশিয়াল কাজের কথা বলে নিয়ে এছে দেহ ব্যবসায় লাগাইছে। এর পেছনে শিশির ও সাজ্জাদ আছে। আরো অনেকেই আছে যাদের নাম জানি না। তারা জো’র করে আমাকে দিয়ে নোং’রা কাজ করায়। দীর্ঘদিন ধরে আমাকে এক রুমেই আ’টকে রাখা হয়েছে। কখনো বের হতে দেয় না। আমি মুক্তি চাই। আমি বের হতে চাই।’

যাত্রাবাড়ী থানা সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের মে ও জুন মাসে একই ব্যক্তিদের মালিকানাধীন হোটেল প্রভাতি ও পপুলার আবাসিক হোটেলের বি’রুদ্ধে পাঁচটি মা’মলা দা’য়ের করা হয়েছে। হোটেল মালিক শিশির চৌধুরীসহ মিশু, পলা’শ মিয়া, আজিজুল, অলিউল্লাহ, জাকির হোসেন নামে কয়েক মানবপা’চারকারীর বি’রুদ্ধে মানবপা’চার প্রতিরোধ ও দ’মন আইনে মা’মলা করা হয়। মা’মলার বিবরণে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে নারীদের আ’টকে রেখে জো’রপূর্বক যৌ’ন ব্যবসা করানোর বি’ষয়টি উল্লেখ করা হয়।

থানা সূত্র জানায়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর নিয়মিত অ’ভিযান ও মা’মলা হলেও আইনকে যেন তোয়াক্কাই করে না প্রভাবশালী চ’ক্রটি। অন্যদিকে বিচারিক ব্যবস্থার ধীরগতির জন্য হোটেল কর্তৃপক্ষ ও মানবপা’চারকারীচ’ক্রটি যেন ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। পুরো বি’ষয়টি জানতে হোটেল মালিক ও মানবপা’চারকারী সিন্ডিকে’টের মূল হোতা শিশির চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে কালের কণ্ঠ। কিন্তু প’লাতক থাকায় তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

র‌্যা’বের মিডিয়া ইউংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈনও বি’ষয়টি স্বীকার করে বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এমন ঘটনার অ’ভিযোগ পেলে নিজেরাই অ’ভিযান চা’লায় র‌্যা’ব। এরই মধ্যে বেশ কিছু নারী পা’চারকারীকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। বাকি চিহ্নিত পা’চারকারীদেরও আইনের আওতায় নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

অন্যদিকে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মুহাম্ম’দ সাইদুর রহমান খান জানান, চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন সময় মানবপা’চারের ঘটনা ঘটছে। এমন অ’ভিযোগ ও অ’পরাধের ঘটনা সম্পর্কে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী অবগত। এ বি’ষয়ে সিআইডি সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে যেন এ ধরনের অ’পরাধ অচিরেই কমে আসে।

স্ব’রা’ষ্ট্র ম’ন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের চলতি বছরের জানুয়ারির প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারা দেশে মানবপা’চারসংক্রান্ত চার হাজার ৯৪৫টি মা’মলা হয়েছে। এর মধ্যে ৫৫৪টি মা’মলার ত’দন্ত চলছে। এসব মা’মলায় মোট আ’সামি ২৪ হাজার ৯১৪ জন। আর মানবপা’চারে জ’ড়িত থাকার অ’ভিযোগে গ্রে’প্তার হয় ১০ হাজার ৯৫১ জন। আর ২০১৯ ও ২০২০ সালে ৫৩টি মা’মলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ১০টি মা’মলায় ১৭ জন আ’সামির যাবজ্জীবন কা’রাদ’ণ্ড হয়। ২০২০ সালে ১৪টি মা’মলা নিষ্পত্তি হয়। এর মধ্যে সাজা হয়েছে একটিতে। সূত্রঃ কালের কন্ঠ