ক্ষমতার সাথে বিপুল পরিমাণ গুপ্তধনও পেলো তালেবান

| আপডেট :  ২৬ আগস্ট ২০২১, ০৬:১৪ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২৬ আগস্ট ২০২১, ০৬:১৪ পূর্বাহ্ণ

প্রায় দুই দশক পর সম্প্রতি আবারও আফগানিস্তানের ক্ষমতা হাতে পেয়েছে তালেবানরা। ইতোমধ্যে তালেবানরা আফগানিস্তানে শরিয়া আইন চালু করার ঘোষণা দিয়েছে এবং সরকার গঠনও প্রায় সম্পন্ন করেচ। তবে এই ক্ষমতার সাথে বিপুল পরিমাণ গুপ্তধনও পেয়েছে তালেবানরা।

মূলত অতি প্রাচীন কাল থেকেই বিভিন্ন সংস্কৃতির লীলাভূমি আফগানিস্তান। বিভিন্ন পুরাণে উল্লেখ রয়েছে এই অঞ্চলের। ‘ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ’ এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের ‘গন্ধর্ব’ হিসেবে উল্লেখ করে বলে মনে করেন পুরাণ বিশেষজ্ঞরা। সে দিক থেকে দেখলে মহাভারতের অন্যতম প্রধান চরিত্র গান্ধারীও আফগানিস্তানেরই কোনও রাজার কন্যা ছিলেন। ‘মার্কণ্ডেয় পুরাণ’ থেকে ‘মহাভারত’— গান্ধার (গন্ধর্বদের বাসভূমি) অঞ্চলকে উন্নততর সভ্যতার উদাহরণ বলেই উল্লেখ করেছে। অধিকাংশ ইতিহাসবিদ গান্ধারকে আজকের আফগানিস্তান বলে চিহ্নিত করেন।

পৌরাণিক কাল থেকে যদি ইতিহাসের নির্দিষ্ট সালতামামির যুগে প্রবেশ করা যায়, দেখা যাবে একের পর এক সাম্রাজ্য ও সংস্কৃতির মধ্যে দিয়ে গিয়েছে এই ভূখণ্ডের ইতিহাস। এর মধ্যে পারসিক সম্রাট সাইরাসের সাম্রাজ্য, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের গ্রিক সাম্রাজ্য, ভারতীয় মৌর্য সাম্রাজ্য, কুষাণ যুগ এবং অবশ্যই বিভিন্ন কালপর্বের ইসলামি সাম্রাজ্য অন্যতম। সেই কারণে এই ভূমির উপরে ব্যকট্রিয়ান-গ্রিক, কুষাণ, হুন, ঘোরি, মুঘল এবং দুররানি সংস্কৃতির প্রভাব পড়েছে।

এই সব সাংস্কৃতিক প্রভাবের চিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে গোটা আফগানিস্তান জুড়ে। সে দেশের রাষ্ট্রীয় সংগ্রহশালায় সযত্নে রাখা রয়েছে গান্ধার শিল্পের নিদর্শন থেকে শুরু করে অনতি অতীতের ইসলামি পুরাতত্ত্বের নিদর্শনও। এর বাইরে সারা দেশেই ছড়িয়ে রয়ছে অসংখ্য পুরাতাত্ত্বিক ক্ষেত্র।

১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান আক্রমণ করে। এবং ১৯৯২ সালের মধ্যে বেশ কিছু প্রত্নক্ষেত্রে সোভিয়েত বাহিনী বা স্থানীয় বাসিন্দারা হানা দিতে থাকেন ‘গুপ্তধনের’ সন্ধানে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে প্রাচীন সভ্যতার বেশ কিছু নিদর্শন-ক্ষেত্র। তালিবান শাসনে এই প্রবণতা অব্যাহত থাকে।

পূর্ব আফগানিস্তানের জালালাবাদ শহরের কাছে হাড্ডায় রয়েছে মহাযান বৌদ্ধ আমলের বেশ কিছু প্রত্নক্ষেত্র। কুষাণ সম্রাট কনিষ্কের পৃষ্ঠপোষকতাতেই ভারতের সীমা ছাড়িয়ে মহাযানবাদ বিস্তৃত হয় বিশ্বের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। হাড্ডার টাপা শোতোর বৌদ্ধ স্তূপ ও মঠে আক্রমণ করে তালেবান বাহিনী।

হাড্ডায় অবস্থিত অন্যান্য প্রত্নক্ষেত্রেও হানা দিতে থাকে তালেবান বাহিনী। খাইবার গিরিপথের লাগোয়া এই অঞ্চলে ছড়িয়ে রয়েছে গান্ধার শিল্পের অজস্র নিদর্শন। খ্রিস্টীয় প্রথম থেকে চতুর্থ শতকের মধ্যে নির্মিত বহু মূর্তিই তালেবানের রোষের সামনে পড়ে।

উত্তর আফগানিস্তানের তাখার প্রদেশে দিগ্বিজয়ী গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডার এক নগরীর পত্তন করেছিলেন বলে জানা যায়। পরে সেই নগরীর উপরে গড়ে ওঠে ব্যাকট্রীয় গ্রিক বা ইন্দো-গ্রিক সভ্যতার কেন্দ্র। উজবেকরা পরে সেই শহরের নাম দেন আই-খানোউম। এখানে অনুসন্ধান চালিয়ে পাওয়া যায় বিপুল প্রত্নসামগ্রী। তালিবদের হাত ঘুরে আই-খানোউম থেকে বহু কিছুই চলে আসতে শুরু করে পাকিস্তানের বাজারে। ব্যক্তিগত প্রত্ন সংগ্রাহকরা তা বিপুল দামে কিনে নিতে থাকেন। তালেবানের হাতে বেশ ভালো পরিমাণে অর্থ সরবরাহ করে এই আই-খানোউমের প্রত্নভান্ডার। তালিবদের প্রথম দফার শাসন শেষ হলে বেশ কিছু প্রত্নবস্তু উদ্ধার করা হয়।

আফগান-পাক সীমান্তে অবস্থিত মির জাকাহ্‌ অঞ্চলে ব্যাকট্রীয়-গ্রিক আমলের প্রচুর মুদ্রা পাওয়া যায়। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫-এর মধ্যে এক কুয়ো থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ রুপো ও ব্রোঞ্জ মুদ্রার সন্ধান মেলে। সেই দুর্মূল্য মুদ্রার এক বড় অংশ তালেবানের হাত হয়ে পাচার হয়ে যায় আন্তর্জাতিক বাজারে।

সোভিয়েত অধিকার এবং তালেবানের প্রথম শাসনে কাবুলের জাতীয় সংগ্রহালয় থেকে প্রচুর মূল্যবান সামগ্রী লুঠ হয় বলে জানা যায়। ১৯৯২ সালে তালিবরা লুঠপাট চালায় জাতীয় সংগ্রহালয়ে। সংগ্রহের প্রায় ৭০ শতাংশই ধ্বংস হয় বা খোয়া যায় এই কাণ্ডে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, তালেবানের অর্থভাণ্ডারকে পুষ্ট করেছে আফগান প্রত্নবস্তুর চোরাচালান এবং লুঠতরাজ। বামিয়ানের ঘটনার পর বিষয়টি নিয়ে খোলাখুলি চর্চা শুরু হয়। ২০০১-এর অক্টোবরে আমেরিকান বাহিনী তালেবান শাসনকে উৎখাত করে।

আবার তালেবান শাসনে আফগানিস্তান। কাবুলের জাতীয় সংগ্রহালয়ের অধিকর্তা মহম্মদ ফাহিম রহিমি জানিয়েছেন, জাদুঘরের বাইরে সশস্ত্র রক্ষী বসিয়েছে তালেবান। আর যাতে বামিয়ান-কাণ্ড না ঘটে, তেমন নির্দেশও নাকি দেওয়া হয়েছে তালিব যোদ্ধাদের।

প্রসঙ্গত, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তান তালেবানের শাসনে ছিল। এর মধ্যে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আল-কায়েদার নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়ার অভিযোগে ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোট সেখানে যৌথ অভিযান চালায়, যার মাধ্যমে তালেবান শাসনের অবসান ঘটে। সেসময় আফগানিস্তানের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা পুরাতাত্ত্বিক ক্ষেত্র ও প্রত্ন-নিদর্শনগুলিকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয় তালেবান। এরপর প্রায় ২০ বছর আবার ক্ষমতা দখল করে তারা। সরকার গঠনের আনুষ্ঠানিকতাও শুরু করেছে তালেবান।

সূত্র: আনন্দবাজার।