২০০০ টাকা দিয়ে শুরু, ঘানি টেনেই কোটিপতি রুহুল আমিন

| আপডেট :  ২৪ আগস্ট ২০২১, ০৭:০৯ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২৪ আগস্ট ২০২১, ০৭:০৯ পূর্বাহ্ণ

জীবন-জীবিকার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে বেঁচে নিয়ে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী ঘানি শিল্পকে আজও আঁকড়ে ধরে আছেন। দেশের বিভিন্ন এলাকায় শিল্পটি বিলুপ্ত হতে বসলেও কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে রুহুল আমিন (৭২) বাপ-দাদার পৈতৃক পেশাকে জীবনের শেষ বয়সে এসেও পরিবর্তন করেননি। তার বাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের নাওডাঙ্গা গ্রামে। তিনি ঐ গ্রামের মৃত রহিম উদ্দিনের ছেলে।

আধুনিক আর ডিজিটাল যুগেও আবহমান গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী শিল্পটি র্দীঘ ৫০ বছর ধরে এ পেশার সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকিয়ে রেখেছেন। দেশের বিভিন্ন এলাকায় এই শিল্প হারিয়ে গেলেও তিনি হারিয়ে যাওয়ার ভিড়ে আজও বাহাত্তর বছরের লড়াকু সৈনিক রুহুল আমিন এই ঘানি টেনেই জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে গড়ে তুলেছেন সুখের সংসার।

রুহুল আমিন পাকিস্তান আমনে নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছেন। ৫ ভাইয়ের মধ্যেই রুহুল আমিন তৃতীয়। বাবা-মা অনেক আগেই মারা যান। ভাইয়েরা কৃষি কাজ করে জীবন-জীবীকা নির্বাহ করলেও রুহুল আমিন কৃষি কাজের পাশাপাশি তিনি বাবার পেশা ও ঘানি শিল্পটাকে বেঁচে নিয়েছেন।

র্দীঘ ৫০ বছর ঘানি শিল্পের আয় দিয়েই তিনি ১ হাজার থেকে ২ হাজার টাকা দরে ৫ বিঘা ও ৬ লাখ টাকা দরে ১০ বিঘা জমি ক্রয় করেছেন জীবন যুদ্ধের এক লড়াকু সৈনিক রুহল আমিন। বর্তমানে প্রতি বিঘার জমির মূল্য ১০ লাখ। ১০ লাখ টাকা ১৫ বিঘা জমির বর্তমান বাজার মূল্য দেড় কোটি টাকা।

রুহুল আমিনের সহযোদ্ধা প্রথম স্ত্রী মারা যান ১০ বছর আগে। এরপর দুই বছরের মধ্যে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর ৭ বছরের একটি কন্যা সন্তান। সে প্রথম শ্রেণীতে পড়ে। প্রথম স্ত্রীর পাঁচ ছেলে। পাঁচ ছেলেকে অনেক চেষ্টা করেও পড়াশুনা করাতে পারেনি। কোন রকমকে কেউ সপ্তম, কেউ অষ্টম, কেউ নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে। পড়াশুনা না করায় পাঁচ ছেলেই বিয়ে করেছেন এবং প্রত্যেক ছেলের নামে তিন বিঘা জমি লিখে দিয়েছেন। জমির পাশাপাশি প্রত্যেক ছেলেকে পাকা বাড়ী করে দিয়েছেন রুহুল আমিন। ছেলেরা কৃষি কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরণের ব্যবসা-বানিজ্য করেই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখেই জীবন-যাপন করছে। নাতি-নাতনিরাও স্কুল-কলেজে পড়াশুনা করছেন।

রুহুল আমিন (৭২) জানান, এ শিল্প যেন আমার রক্তের প্রতিটি কনিকায় মিশে আছে। গরু দিয়ে ঘানি টেনে খাঁটি সরিষার তেল বানানো তাদের বাপ-দাদার পেশা। আমার বাবাও সরিষার ঘানি টেনে জীবন-জীবীকাসহ আমাদের পাঁচ ভাইকে মানুষ করেছেন। অন্য ভাইয়েরা অন্য পেশায় যুক্ত হলেও আমি আমার বাবার পেশাটাকে বেঁচে নিয়েছি। প্রায় ৫০ বছর ধরে এ শিল্পটা বেঁচে রেখেছি। মাত্র দুই হাজার টাকা দিয়ে শুরু করেছি। আল্লাহর অশেষ কৃপায় স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে অনেক সুখেই আছি। ঘানি এ শিল্পের আয় দিয়ে ১৫ বিঘা জমি কিনেছি। পাঁচ ছেলেকে জমিসহ পাকা বাড়ী করে দিয়েছি। ছেলেরাও তাদের স্ত্রী-সন্তানসহ অনেক সুখেই আছেন।

তিনি আরও জানান, বর্তমানে চাহিদা কম থাকায় দুইদিন পরপর ১০ কেজি সরিষার ঘানি টানা হয়। ১০ কেজি সরিষার দাম ৬২৫ টাকা। ১০ কেজি সরিষা থেকে ৩ কেজি তেল আসে। বিকালে বালারহাট বাজারে নিজের দোকানে প্রতি কেজি খাঁটি সরিষার তেল ৩৪০ টাকা দরে বিক্রি করি। তেলের পাশাপাশি ১০ কেজি সরিষা থেকে ৭ কেজি খৈল আসে। ৫০ টাকা কেজি দরে খৈল বিক্রি করা হয়। ৩ কেজি তেল বিক্রি হয় ১ হাজার ২০ টাকা। ৭ কেজি খৈল বিক্রি হয় ৩৫০ টাকা। তেল ও খৈল ১ হাজার ৩৯০ টাকা। মাত্র ১০ কেজি সরিষার ঘানি টেনে ৭৬৫ টাকা আয় করেন নুরুল আমিন।

১০ কেজি সরিষার ঘানি টানতে সময় লাগে ৩ থেকে ৪ ঘন্টা। গড়ে প্রতি মাসে ২০ হাজার থেকে ২৩ হাজার টাকা আয় করেন। আগে ঘানির খাঁটি সরিষার তেল কেনার জন্য দুর-দুরান্তর থেকে মানুষজন বাড়ীতে ভির করতো। আগে চাহিদা থাকায় প্রতিদিন ৩০ কেজি থেকে ১ মন সরিষার ঘানি টানতাম। এখন চাহিদা কম হওয়ায় দুইদিন পরপর ১০ কেজি সরিষার ঘানি টানতে হচ্ছে।

প্রতিবেশি হাবিবুর রহমান সঞ্জু ও বজলু রশিদ জানান, তিনি একজন কর্মঠ ব্যক্তি। এই বয়সে এখনো তিনি কৃষি কাজের পাশাপাশি ঘানি টানছেন। এটা এক বিরল দৃষ্টান্ত। এই শিল্পদিকে তিনি অনেক কিছুই করেছেন। এক একজন চাকুরি জীবী মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি ঐ পরিবারের একজন আদর্শ বাবা। তিনি বেঁচে থাকতেই সব ছেলেকে জমিসহ পাকা বাড়ী করে দিয়ে বাবার দায়িত্ব পালন করেছেন। সত্যিই গর্ভের বিষয়। মানুষটাও খুবেই সহজ সরল। তিনি কর্মের মাঝে বেঁচে থাক এই কামনায় করছি।