পরীমণির বিচার ও সমাজের ময়নাতদন্ত

| আপডেট :  ১৭ আগস্ট ২০২১, ০৫:০২ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ১৭ আগস্ট ২০২১, ০৫:০২ পূর্বাহ্ণ

প্রতিবছর আগস্ট আসে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সংঘটিত মানব ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডের নির্মম শিকার বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের সদস্যদের নাম এই মাস জুড়ে আমরা পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করি। রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েও বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বর্বরতম হত্যাকাণ্ডের বিচার বাংলাদেশের প্রচলিত আইনের মাধ্যমে করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন।

প্রচলিত আইন তাকে হতাশ করেনি, দীর্ঘ ৩৫ বছর তিনি বিচার পেয়েছেন এবং এখনো বেশ কিছু খুনি অধরা আছে। প্রসঙ্গটি অবতারণা করার কারণ হলো, সাম্প্রতিক চলচ্চিত্রের একজন প্রতিষ্ঠিত নায়িকা পরীমণি ও তাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ঘটনায় সমাজের যে স্থলন ফুটে উঠেছে, অধঃপতিত চেহারা ফুটে উঠেছে তা নারীদের প্রতি নগ্ন পিতৃতান্ত্রিক আগ্রাসনকেই স্পষ্ট করে তুলেছে।

গত তিন দশকে শিক্ষক ও মানবাধিকার কর্মী হিসেবে একজন নারীর বিরুদ্ধে এরকম অবিশ্বাস্য ও যূথবদ্ধ আক্রমণ দেখিনি। অথচ সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ২৮(২) বলা আছে, ‘রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সমান অধিকার লাভ করবেন’ এবং ধারা ২৭ এ বলা আছে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।

নারীকে সাংবিধানিকভাবে কোনো প্রকারেই অধস্তন হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না বিধায় ২৮(১) ধারায় বলা হয়েছে যে, কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না। কিন্তু লক্ষণীয় পরীমণি স্পষ্টতই ‘যৌনবস্তু’ হিসেবে টার্গেট হয়েছেন।

স্টকহোম সিনড্রোম অনুযায়ী, অপরাধীর পক্ষেও সহমর্মিতা তৈরি হয়। শুরুতে পরীমণি তা পাননি, তবে তিনি আস্তে আস্তে তা পেতে শুরু করেছেন। এফডিসির শিল্পী সমিতি পরীমণীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ বিশ্লেষণ না করেই সদস্যপদ স্থগিত করেছে।

ইউরোপের মধ্যযুগের কায়দায় পরীমণি সম্পর্কে গণমাধ্যমগুলো প্রতিবেদন করেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষ মেতে উঠেছে বীভৎস কায়দায়। পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যুদণ্ড দিতে বলেছে।
পরীমণির বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ, বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে তার বিচার হবে। কিন্তু কেন তাকে এত হৈচৈ করে বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া হলো ও পরে রিমান্ডে নেওয়া হলো?
এরচেয়েও বড় দুর্নীতিবাজ ও কারখানায় ৫২ জন মানুষ পোড়ানোর পরও কারখানার মালিক জামিনে মুক্তি পায়। তাই সমাজের অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে নারী ও পুরুষকে অবধারিতভাবে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে হবে।

পিতৃ-মাতৃহারা পরীমণির শিক্ষার ঘাটতি ছিল, অল্প বয়সে সংসার ভাঙার ট্রমা ছিল, ভালোমন্দ বোঝার ক্ষমতার অভাব ছিল। অন্যদের তো তা ছিল না।
কোনো বিচার বিশ্লেষণ না করে যদি পরীমণিকে দোষী ধরা হয় তাহলে প্রশ্ন আসে, কারা পরীমণিকে তৈরি করল? কেন সমাজে পরীমণি তৈরি হয়? এর উত্তরে সবাই চুপ।

ইতিবাচক দিক হচ্ছে, ধীরে ধীরে শিল্পীরা মুখ খুলেছেন এবং বলেছেন, তার বেড়ে ওঠার সঙ্গে আর দশজনের বেড়ে ওঠার পার্থক্য আছে। তার সংগ্রাম আলাদা। আর এই সুযোগটাই নিয়েছে নব্য বণিক শ্রেণি, যারা চক্র তৈরি করে কিছু মিডিয়া কর্মীদের বিভিন্ন অনাচারে লিপ্ত করে এবং শিল্পচর্চা থেকে তাদেরকে দূরে সরিয়ে আনে। এতে করে আমাদের শিল্প ও শিল্পী সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটা শিল্পজগৎকে কলুষিত করছে ও মানুষের মনে এই জগৎ সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি করছে। কিন্তু ব্যবসা ও চলচ্চিত্রের সব পুরুষেরা খারাপ নন।

পরীমণি ইস্যুতে নব্য বণিক সমাজের যে চেহারা ফুটে উঠেছে তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশিষ্ট সংস্কৃতিজনেরা। তারা পরীমণি বিষয়ে নারী বিদ্বেষী পুরুষতান্ত্রিকতার বিস্তার প্রত্যক্ষ করে ব্যথিত ও উদ্বিগ্ন।

অপরাধ দমন, তদন্ত ও বিচারিক দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু দুর্ভাগ্য, অভিযুক্ত যদি শো-বিজের সাথে সম্পৃক্ত হয় ও নারী হয় তাহলে তার চৌদ্দগুষ্টির ইজ্জতের ময়নাতদন্ত, মিডিয়াতে রগরগে আলোচনা, নারীর চালচলন ও জীবন যাত্রা নিয়ে নৈতিক পুলিশিং এর মাধ্যমে সেই নারীকে প্রায় নির্বাসনে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।

শেষে বলতে চাই, পরীমণির সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা হোক এবং প্রত্যাশা করি, সরকার এদিকে যথাযথ নজর দেবেন। লেখার শুরুতেই বলেছিলাম, প্রচলিত আইন প্রতি আস্থা রাখার কথা। আমরাও প্রচলিত আইনে আস্থা রাখতে চাই। কেবলমাত্র বিচারে অপরাধী প্রমাণ হওয়ার পরই পরীমণিকে অপরাধী বলা যাবে। তার আগেই মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার বিচার করা হলে তা হবে সমাজের অসুস্থতার পরিচায়ক। এমন সমাজেরও ময়নাতদন্ত হওয়া দরকার।

অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম ।। ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক তথ্য কমিশনার

সূত্রঃ ঢাকা পোস্ট