প্রতিটি ঘরকে কি অবশ্যই ভালবাসা দিয়ে গড়া হতে হবে?

| আপডেট :  ১৪ আগস্ট ২০২১, ০৫:৪৫ অপরাহ্ণ | প্রকাশিত :  ১৪ আগস্ট ২০২১, ০৫:৪৫ অপরাহ্ণ

প্রতিটি ঘরকে কি অবশ্যই ভালবাসা দিয়ে গড়া হতে হবে?
একলোক তার স্ত্রীকে তালাক দেবার চিন্তা করছিল। সে উমর ইবন আল-খাত্তাবের (রাঃ) কাছে বিষয়টা প্রকাশ করলে তিনি কারণ জিজ্ঞেস করলেন। লোকটা বলল, “আমি তাকে আর ভালবাসিনা।” উমর (রাঃ) বললেন, “প্রতিটি ঘরকে কি অবশ্যই ভালবাসা দিয়ে গড়া হতে হবে? তাহলে পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ততা ও কৃতজ্ঞতাবোধের কী হবে?”

আমাদের মধ্যে ভালবাসা-বাসির ব্যাপারটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। সংসার পাতে একজন নারী ও পুরুষ পরস্পরকে পসন্দ করে একটি নতুন পরিবারের ভিত্তি স্থাপনের নিমিত্তে। সময়ের আবর্তনে তাদের মধ্যে ভালবাসার সাথে সাথে দয়া, সহমর্মিতা, বিশ্বস্ততা ও কৃতজ্ঞতাবোধ গড়ে উঠে। আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ

وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُم مِّنْ أَنفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِّتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُم مَّوَدَّةً وَرَحْمَةً
“আর তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে এও রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সংগিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।” (৩০:২১)

এভাবে সংসারের ভিত্তি মজবুত হয়। সন্তান সন্তুতি ও আত্মীয়স্বজন নিয়ে গড়ে উঠে সমাজ। নিতান্ত “ভালবাসা” দিয়েই শুধু এটা গড়ে উঠেনা। আর এটাকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রতি ক্ষেত্রেই শুধু ভালবাসা দিয়ে সম্ভব নয়। পারপস্পরিক কৃতজ্ঞতাবোধ ও পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ততা পরিবার ও সমাজকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে। এজন্যই স্বামী-স্ত্রীর কারো কাউকে পসন্দ না হলেই বিচ্ছেদের দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিৎ নয়। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,

وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ ۚ فَإِن كَرِهْتُمُوهُنَّ فَعَسَىٰ أَن تَكْرَهُوا شَيْئًا وَيَجْعَلَ اللَّـهُ فِيهِ خَيْرًا كَثِيرًا
“নারীদের সাথে সদ্ভাবে জীবন-যাপন কর। অতঃপর যদি তাদেরকে অপসন্দ কর, তবে হয়ত তোমরা এমন এক বিষয়কে অপসন্দ করছ, যাতে আল্লাহ অনেক কল্যাণ রেখেছেন।” [৪:১৯]
এজন্যই আল-ফারুক উমর (রাঃ) ঐ লোকটাকে ওরকমভাবে বলেছেন। একইভাবে এক মহিলা এসে তাঁর কাছে তার স্বামীর ব্যাপারে অভিযোগ করলেন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার নিয়তে।

তিনি বলল, “আমীরুল মু’মিনীন! আমার স্বামী খুবই খারাপ মানুষ এবং তার মধ্যে কোন কল্যাণ অবশিষ্ট নেই।”
উমর (রাঃ) বললেন, “তোমার স্বামী কে?”
তিনি বললেন, “আবূ সালামাহ্‌।”
উমর (রাঃ) তাকে চিনতেন, কারণ তিনি রসূলুল্লাহর (সঃ) সাহাবী ছিলেন। উমর (রাঃ) মহিলাকে বললেন, “আমরাতো তোমার স্বামীর ব্যাপারে ভাল ছাড়া খারাপ কিছু জানিনা।” উমর (রাঃ) তাঁর সাথে থাকা এক লোককে বললেন, “তুমি কী মনে কর?” তিনি বললেন, “আমীরুল মু’মিনীন! আমরাও এর বাইরে[মানে তার ভাল হওয়া ছাড়া] আর কিছু জানিনা।”

উমর (রাঃ) তখন মহিলার স্বামীকে ডেকে আনতে লোক পাঠালেন এবং স্ত্রীলোকটাকে তাঁর পেছনে বসতে বললেন। আবূ সালামাহ্‌ (রাঃ) আসলে উমর তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি এই মহিলাকে চেন কিনা?”
তিনি বললেন, “আমীরুল মু’মিনীন, কে সে?”
উমর (রাঃ) বললেন, “সে তোমার স্ত্রী।”
তিনি বললেন, “সে আপনাকে কী বলেছে?”

উমর বললেন, “সে দাবী করছে যে তুমি খুবই খারাপ মানুষ এবং তোমার মধ্যে কোন কল্যাণ অবশিষ্ট নেই।”

তিনি বললেন, “আমীরুল মু’মিনীন সে কতই না খারাপ কথা বলেছে। আল্লাহর কসম সে সবচেয়ে উত্তম কাপড় পরিধানকারীনী ও সবচেয়ে আমারদায়ক বাসস্থানের অধিকারিণী। [মানে আমি তাকে উত্তম পোশাক পরিধান করাই ও আরামদায়ক বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছি।]” এরপর তিনি আমীরুল মু’মিনীনকে উপমা দিয়ে একটা কথা বললেন – যার অর্থ হল তিনি বৃদ্ধাবস্থার কারণে পৌরুষত্ব হারিয়েছেন।
উমর মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তুমি এ ব্যাপারে কী বল?”
মহিলা বললেন, “তিনি সত্যই বলেছেন।”

উমর তখন তার কঞ্চিটা নিয়ে মহিলাকে আঘাত করলেন এবং বললেন, “হে আপনার দুশমন! তুমি তার যৌবনের রস আহরণ করেছো ও তার সম্পদ ভোগ করেছ; আর এখন বৃদ্ধাবস্থায় তার সম্পর্কে এমন কথা বলেছ যা সত্য নয়।”
সে বলল, “আমীরুল মু’মিনীন! আপনি আমাকে এ বারের মত আমার অবস্থায় ছেড়ে দিন। আল্লাহর কসম আপনি আমাকে আর এরকম করতে দেখবেন না।”

তিনি বললেন, “আল্লাহকে ভয় কর এবং এ বৃদ্ধের উত্তম সঙ্গীনি হয়ে থাকো।” তিনি আবূসালামাহর দিকে ফিরে বললেন, “আমাকে তার সাথে যে আচরণ করতে দেখেছো তা যেন তোমাকে তার উত্তম সাথী হয়ে জীবন যাপন করা থেকে বিরত না রাখে।”
আবূ সালামাহ বললেন, “আমি তাই করবো [যেভাবে আপনি নির্দেশ দিলেন]।”

উমরের (রাদিয়াল্লাহু আনহু ওয়া আরদাহ) উপরের ঘটনা দু’টো থেকে আমরা দেখতে পাই শুধুমাত্র রোমান্টিক ভালবাসাই নয়, পরস্পরের প্রতি দায়িত্বানুভূতি, বিশ্বস্ততা এবং কৃতজ্ঞতাবোধকেও বিবেচনায় নিতে হবে ঘর বাঁধার ক্ষেত্রে এবং ঘরকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে। শুধু রোমান্টিক ভালবাসা চিরকাল টিকে থাকেনা। কিন্তু কৃতজ্ঞতাবোধ, বিশ্বস্ততা ও দয়া-মমতা ঘরকে টিকিয়ে রাখতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এই বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিতে চায়না, বিশেষ করে আমাদের সময়ে যখন রোমান্টিক ভালবাসার জয়জয়কার।

আবূসামীহাহ
নোটঃ উমরের ঘটনা দুটোর জন্য দেখুন as-Sallabi, Ali Muhammad (2007). “Umar ibn al-Khattab: His life and Times”, Vol.1, pp 269-270. International Islamic Publishing House (IIPH), Riyadh.
#ভালবাসা
#সংসার
#বিশ্বস্ততা
#দয়া_মমতা