হেলেনা-পিয়াসা-মৌদের রংমহলে অতিথি কারা!

| আপডেট :  ৪ আগস্ট ২০২১, ০৭:২৮ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ৪ আগস্ট ২০২১, ০৭:২৮ পূর্বাহ্ণ

এই তিনজন নারীই সময়ের সবচে আলোচিত এবং সমালোচিত নাম। হেলেনা জাহাঙ্গীর প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হলেও বাকি দুইজন কথিত মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা এবং মৌ আক্তারের দৃশ্যমান কোনো বৈধ আয়ের উৎস না থাকলেও তাদের বিলাসী ও বেপোরোয়া জীবনাচরণ সমাজের এক ন’ষ্ট নোং’রা চিত্রকেই ফুটিয়ে তুলেছে। এই তিনজনেরই একটা বিশেষ জায়গায় মিল রয়েছে, তা হচ্ছে তা রংমহলের রঙিন দুনিয়াতে এতদিন বাস করেছেন। এমনকি তাদের রং মহলে নিয়মিত অতিথি হয়েছেন সমাজের নানা শ্রেণী-পেশার প্রভাবশালী ও অর্থ বিত্তের মালিকরা। হেলেনা জাহাঙ্গীর, ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা এবং মৌ আক্তারের রংমহলে মধু পান করতে যাওয়া অতিথিদের নাম ইতিমধ্যেই ত’দন্তকারীদের কাছে প্রকাশ করেছে তারা।

র‌্যা’ব এবং গো’য়েন্দা পুলিশের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র ভোরের পাতাকে নিশ্চিত করেছে হেলেনা জাহাঙ্গীর, পিয়াসা এবং মৌ আক্তার ইতিমধ্যেই অনেক প্রভাবশালীর নাম উচ্চারণ করেছে। অনেকের সঙ্গে টাকার বিনিময়ে অ’নৈতিক সম্পর্ক স্থাপন থেকে শুরু করে প্র’তারণা ব্যবসার কথাও তারা অকপটেই স্বীকার করেছেন।

সূত্র জানিয়েছে, হেলেনা জাহাঙ্গীর স’রকারের একজন মন্ত্রীর সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় বেপোরোয়া হয়ে উঠেছিলেন। তার সঙ্গে হেলেনার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথাও স্বীকার করে নিয়েছে হেলেনা। তবে তার রাজনৈতিক উত্থানের পিছনে সেই মন্ত্রীকে ব্যবহার করা হয়নি। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ এক শীর্ষ নেতার সাথে তার গভীর সখ্যতা কাজ করেছে বলেও জানিয়েছে সূত্রটি। এমনকি বিএনপি পন্থী এক ব্যবসায়ী নেতা যার সাথে খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠ পুত্র আরাফাত রহমান ককোর স্ত্রী সৈয়দা শর্মিলা রহমান সিথির ঘনিষ্ঠতা রয়েছে, তার সঙ্গে হেলেনা জাহাঙ্গীরের খুবই অন্তরঙ্গ ঘনিষ্ঠতা রয়েছে বলেও হেলেনা জি’জ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন।

মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার আসার পরই বেপেরোয়া জীবনযাপন শুরু করেননি। তার অন্ধকার রংমহলের প্রথম’দিকের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এশিয়ান টিভির সাবেক এমডি এবং কক্সবাজারের হোয়াইট সেন্ড লিমিটেড ও সোহা’না গ্রুপের বর্তমান চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। ২৮ কোটি টাকা জালিয়াতির মা’মলায় তিনি বর্তমানে জে’লে রয়েছেন।

চট্টগ্রামের আলী এন্টারপ্রাইজের মালিকের ছেলের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে ১৫ বছর আগে ঢাকায় পা রাখেন পিয়াসা। নানা জায়গায় চাকরির চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এক পর্যায়ে একটি বেস’রকারি টেলিভিশনের কর্মকর্তা মিজানের সঙ্গে তার সখ্য হয়। মিজান তাকে বিয়ে না করলেও অনেকেই তাদেরকে স্বামী-স্ত্রী বলে জানত। এ সময় পিয়াসা নিজেকে সংশ্লিষ্ট টেলিভিশনের পরিচালক বলে পরিচয় দিতে শুরু করেন। এরই সূত্র ধরে হাই সোসাইটিতে পরিচিত হয়ে ওঠেন পিয়াসা। এর পরের দিনগুলো রীতিমতো ইতিহাস। একে একে পিয়াসার বন্ধু তালিকায় যোগ দেন উচ্চপদস্থ স’রকারি কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তা ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ীরা।

এক পার্টিতে পিয়াসার সঙ্গে পরিচয় থেকে ঘনিষ্ঠতা হয় স্বর্ণালংকার ব্যবসায়ী আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদের। শেষ পর্যন্ত সাফাত তাকে বিয়ে করেন। কিন্তু দাম্পত্য বেশিদিন টেকেনি। ২০১৭ সালে পিয়াসাকে ডি’ভোর্স দেন সাফাত। কিন্তু ডি’ভোর্স মেনে নিতে পারেননি পিয়াসা। তিনি প্র’তিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠেন। বনানী রেইনট্রি হোটেলের ধ”ণ কাণ্ডে সাফাতের নাম জড়িয়ে গেলে দৃশ্যপটে পিয়াসার আবির্ভাব ঘটে। মা’মলার দুই বা’দীকে নিয়ে তৎপর হয়ে ওঠেন তিনি। এক পর্যায়ে আপন জুয়েলার্সের মালিকের সঙ্গে মোটা অংকের অর্থ চেয়ে দর কষাকষি শুরু করেন পিয়াসা। অ’তিষ্ঠ হয়ে তার বি’রুদ্ধে চাঁ’দাবাজির মা’মলা করেন আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ সেলিম। মা’মলাটি এখনো চলমান। অবশ্য সেলিমের বি’রুদ্ধে গ’র্ভপাতের পালটা মি’থ্যা মা’মলা দিতে ছাড়েননি পিয়াসা।

পিয়াসার মাধ্যমে আম’দানি নি’ষিদ্ধ উচ্চ ক্যালিবারের মূল্যবান অ’স্ত্র কেনাবেচা শুরু হয় কয়েক বছর আগে। বিশেষ করে লিমিটেড এডিশনের উজি পি’স্তলের বিভিন্ন মডেল তার মাধ্যমেই দেশে আসে। কোনোটির দাম দেড় কোটি টাকা। তবে তিনি এক্ষেত্রে বড় দুঃসাহসও দেখিয়েছেন। এসব অ’স্ত্রের ছবি তার ফেসবুকেও রয়েছে। সেসব ছবিতে তিনি নিজেকে অনেকটা মাফিয়া ডনের মুডে শো করেছেন। ক্লাবে যাতায়াতের সূত্র ধরে মূলত তিনি ধনাঢ্য শৌখিন অ’স্ত্র ক্রেতার খোঁজ পান। আম’দানি নি’ষিদ্ধ অ’স্ত্র আনা হয় শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চোরাই পথে। এক্ষেত্রে তিনি এক প্রভাবশালীর পৃষ্ঠপোষকতা পান।

জানা যায়, বনানী ক্লাব ছাড়াও পিয়াসার পার্টি হয় ফ্লোর সিক্স ও মিন্ট আল্ট্রা লাউঞ্জ নামের সিসা বারে। জন্ম’দিনের অনুষ্ঠানের কথা বলে আয়োজিত পার্টিতে ভিআইপিদের আড্ডা জমত। প্রায় প্রতি পার্টিতে মিশু নামের এক যুবকের সঙ্গে পিয়াসাকে ঘনিষ্ঠ দেখা যায়। কোটিপতি মিশু বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। টেক্সাসে তার বাড়ি রয়েছে।

পিয়াসার বন্ধু হিসাবে পরিচিত মিশু বেশিরভাগ সময় বিদেশে থাকলেও ঢাকায় তার শুল্কমুক্ত চোরাই গাড়ির ব্যবসা রয়েছে। বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ ও রেঞ্জ রোভার ব্র্যান্ডের গাড়ি বিক্রি করেন মিশু। প্রভাবশালীদের স’ন্তানরা এসব গাড়ির ক্রেতা। ব্যবহার হয় ভুয়া নম্বর প্লেটে। এছাড়া ডেইরি সান নামে একটি গরুর খামারে বিনিয়োগ রয়েছে পিয়াসার। তবে খামারের আড়ালে মা’দক চোরাচালানের অ’ভিযোগ আছে। এছাড়া ফ্লোর সিক্সের মালিক সাঈদের সঙ্গে পিয়াসার ঘনিষ্ঠতা ওপেন সিক্রেট। নরসিংদীর বাসিন্দা সাঈদ বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জ’ড়িত হলেও ঢাকার শোবিজ জগতে তিনি ব্যাপক পরিচিত। ক্ষমতার বলয়ে তার ওঠাবসা। এছাড়া রাজধানীর গুলশানে হোটেল আমারিতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল পিয়াসার। সেখানে তার সঙ্গে ক্যা’সিনো কারবারে জ’ড়িত কয়েকজন যুবলীগ নেতাকেও দেখা যায়। আমারি হোটেলের লবিতে পিয়াসার সঙ্গে একই টেবিলে আড্ডায় মত্ত এক এমপির ছবি ইতোমধ্যে ভাইরাল হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পিয়াসার ঘনিষ্ঠভাজনদের নামের তালিকা বেশ লম্বা। প্রভাবশালীদের অনেকেই রয়েছেন তার বন্ধু কিংবা বয়ফ্রেন্ডের তালিকায়। পিয়াসার ঘনিষ্ঠভাজনদের মধ্যে সবার উপরে আছে একটি শিল্প গ্রুপের অন্যতম কর্ণধার। তার সঙ্গে পিয়াসার ঘনিষ্ঠ একাধিক ছবি ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। পিয়াসার সঙ্গে তার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। এ কারণে একটি অভিজাত ক্লাবে গেলে গভীর রাতেও পিয়াসার জন্য বার কাউন্টার খোলা হয়।

এছাড়া তার বন্ধু তালিকায় নাম আছে জনৈক জামান, রানা ওরফে শফিউল্লাহ, একটি বিদ্যুৎ প্লান্টের মালিকের ছেলে সাইফ, জ’ঙ্গি কানেকশনে বন্ধ হয়ে যাওয়া লেকহেড স্কুলের মালিক খালেদ, ইয়াবা ডন শালেহ চৌধুরী ওরফে কার্লোস, এক শিল্পপতির নাতি ফাহিম, চট্টগ্রামের গাড়ি ব্যবসায়ী রুবায়েত খান, কাকরাইলের একটি বড় আবাসিক হোটেলের মালিকের ছেলে রাজিব, চেক জালিয়াতির মা’মলায় কা’রাব’ন্দি জাতীয় পার্টির নেতা শাফিউল্লা মনির, বিএনপি নেতা এসএস খালেকের ছেলে সাজু ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ভাতিজা সাকের কাদের চৌধুরী। এছাড়া খুলনা থেকে আসা ধনাঢ্য ব্যবসায়ী শাহরিয়ার ওরফে শেখ শাহরিয়ারের সঙ্গে পিয়াসার ঘনিষ্ঠতা দেখা যায়। তাদের দু’জন হোটেল ওয়েস্টিনে পার্টি শেষে গভীর রাতে লং ড্রাইভে বের হতেন।

এছাড়া, পিয়াসার রংমহলের নিয়মিত মধুপানকারী হিসাবে একটি বেস’রকারি ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তার নামও উঠে এসেছে। তিনি ব্যাংকে যতটা সময় না দেন, তার চেয়ে বেশি সময় দেন বাংলাদেশ ব্যাংকে নানা তদবির আর পিয়াসাকে। এমন অ’ভিযোগ করেছেন খোদ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা।

জানা যায়, বারিধারা আবাসিক এলাকার ৯ নম্বর রোডের একটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে ভাড়া থাকতেন পিয়াসা। সার্ভিস চার্জ ও সিকিউরিটি বিল বাদে শুধু ফ্ল্যাট ভাড়া ৩ লাখ টাকা। অথচ দৃশ্যমান কোনো আয় নেই পিয়াসার। বিশাল ফ্ল্যাটে তিনি একাই থাকেন। তার রান্নাবান্নাসহ ব্যক্তিগত কাজের জন্য কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শাহজাহান নামের এক বাবুর্চি তার ফ্ল্যাটে রান্নার কাজ করেন।

বলাবাহুল্য পিয়াসার ফ্ল্যাটে প্রভাবশালীদের যাতায়াত ছিল বা’ধাহীন। ক’রোনায় পাঁচতারকা হোটেলগুলো বন্ধ হয়ে গেলে নিয়মিত পার্টি হতো তার ফ্ল্যাটেই। ইয়াবা ও ম’দ পানের সব আয়োজন থাকত রেডি। কোটি টাকা মূল্যের দুটি ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করেন পিয়াসা। এর একটি বিএমডব্লিউ এবং অন্যটি মাজদা ব্র্যান্ডের। এছাড়া তার আরও একটি লাল রংয়ের ফেরারি রাখা হয়েছে গুলশান-২ এর একটি শোরুমে। ৬ হাজার সিসির গাড়িটি বিক্রির জন্য ক্রেতা খুঁজছিলেন পিয়াসা।

এদিকে ডি’বি সূত্র জানায়, পিয়াসা ও মৌ একই সিন্ডিকে’টে কাজ করে। পিয়াসা নিজেকে আরএম গ্রুপের পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের পরিচালক হিসেবে পরিচয় দেয়। এর বাইরে তার আয়ের বড় ধরনের কোনো উৎস পাওয়া যায়নি। আর মৌ বৈধ আয়ের কোনো উৎসই দেখাতে পারেনি। তবে তার স্বামী ও সে একাধিক ক্লাবের সদস্য। মূলত কথিত মডেল মৌ আক্তারের মাধ্যমে পিয়াসা অল্প বয়সী এবং উচ্চাভিলাষী মেয়েদের সংগ্রহ করতো। পরে তাদের মাধ্যমে পার্টির নাম করে সমাজের নানা শ্রেণী পেশার প্রভাবশালীদের সঙ্গে আ’পত্তিকর ছবি ও গো’পনে ভিডিও ধারণ করে ব্লাকমেইলিং করতো।

এদিকে, মৌ আক্তার আ’টকের সময় গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, আমার বি’রুদ্ধে ষ’ড়যন্ত্র হয়েছে। ‘ভ’ অধ্যাক্ষরের একটি বিপনী প্রতিষ্ঠানের মালিকের স্ত্রীর সঙ্গে বেস’রকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার প’রকীয়ার বি’ষয়টি আমি জেনে ফেলায় আমাকে ফাঁ’সিয়ে দেয়া হয়েছে।

ডি’বি পুলিশের যুগ্ম কমিশনার হারুন-অর রশীদ বলেন, দুজন (দুই মডেল) একটি সংঘবদ্ধ চ’ক্রের সদস্য। তাদের বি’রুদ্ধে ব্ল্যা’কমেইলিংয়ের অনেক অ’ভিযোগ পেয়েছি। সেসব ঘটনা ত’দন্ত করতে গিয়ে তাদের বাসায় অ’ভিযান চা’লানো হয়। দুজনের বাসায় বিদেশি ম’দ, ইয়াবা ও সিসা পাওয়া গেছে। মৌয়ের বাড়িতে ম’দের বারও ছিল। তিনি বলেন, গ্রে’ফতার হওয়া দুই মডেল হলো রাতের রানি। তারা দিনের বেলায় ঘুমায় এবং রাতে অ’শ্লীল কর্মকাণ্ড করে।