নিজের জীবনে খাওয়া হয়নি, তা-ও কেন পান্তা ভাত দেখে আবেগে ভাসলো লক্ষ লক্ষ বাঙালি

| আপডেট :  ১৪ জুলাই ২০২১, ০৭:০১ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ১৪ জুলাই ২০২১, ০৭:০১ পূর্বাহ্ণ

স্মোক্ড রাইস ওয়াটার! নাম যতই পোশাকি হোক, আদপে তা গ্রাম বাংলার পান্তা ভাত। অস্ট্রেলিয়ার জনপ্রিয় রান্নার প্রতিযোগিতা ‘মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া’। ১৩তম সিজনে তিন মাস লড়ে ২৪ জনের মধ্যে চূ়ড়ান্তে পর্বে পৌঁছেছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কিশ্বর চৌধুরী। তিনি বিচারকদের মন জিতলেন পান্তা ভাত, আলু ভরতা এবং মাছভাজা রান্না করে! পাশাপাশি মন জয় করলেন বিশ্ব জুড়ে লক্ষ লক্ষ বাঙালিরও।

খাওয়া-দাওয়া নিয়ে চিরকালই বড় বাতিক আমার। পেটখারাপ না হলে মুড়ি খাব না। আমের মরসুম না হলে দই চিড়ে ছুঁয়েও দেখব না, দুধ-রুটি খাওয়ানোর বৃথা চেষ্টা মা অনেক ছোটবেলাতেই ছে়ড়ে দিয়েছিলেন। খুব ছোটবেলায় দাদুর বাড়িতে দেখতাম সকালবেলা সকলে রান্নাঘরের মাটিতে সার দিয়ে বসতেন। দিদিমা একে একে পান্তা ভাত দিতেন সকলের পাতে। কেউ খেত গুড় দিয়ে, কেউ পেঁয়াজ-কাঁচা লঙ্কা-সর্ষের তেল দিয়ে, কেউ কেউ আবার উপরে চানাচুর ছড়িয়ে! তাঁদের মুখে তৃপ্তি দেখে অবাক হয়ে যেতাম। কিন্তু এই অদ্ভুত খাবার নিজে কখনও মুখে তুলিনি। তা-ও কেন কিশ্বরকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে পান্তা ভাত রান্না করতে দেখে এত আনন্দ হল?

প্রতিযোগিতার শুরুতেই কিশ্বর বলেছিলেন, বাংলাদেশি খানাকে বিশ্বের খাদ্য-মানচিত্রে জায়গা করে দেওয়াই তাঁর লক্ষ্য। দুই সন্তানের মা ৩৮ বছরের কিশ্বর বই লিখতে চান। পান্তা ভাত ছাড়াও নানা রকম মাছের ঝোল, খিচুড়ি, বেগুনের ভরতা, ফুচকার মতো নানা বাঙালি পদ তিনি এই প্রতিযোগিতার বহু পর্বে পেশ করেছেন। এবং প্রশংসা কুড়িয়েছেন সকলের কাছ থেকে। একদম শুরুতে তিনি তৈরি করেছিলেন আম দিয়ে মাছের ঝোল আর বিটের সঙ্গে বেগুনের ভরতা। তাঁর রান্না খেয়ে বিচারক অ্যান্ডি এলেন খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘এতদিন কোথায় ছিলেন আপনি?’’ আবেগপ্রবণ হয়ে কিশ্বর ফুঁপিয়ে কেঁদে বলেছিলেন, ‘‘জাস্ট অ্যাট হোম।’’ কথাটা কিছুতেই ভুলতে পারিনি আমি।

সত্যিই তো! এমন কত পদ আমাদের প্রত্যেকের বাড়িতে লুকিয়ে রয়েছে। মা-ঠাকুমারা বাচ্চাদের ভোলাতে নানা রকম খাবার তৈরি করেন। সেগুলো কেউ জানতেও পারেন না। কোনও খ্যাতনামা রেস্তরাঁর মেনুতে জায়গা করে নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আমার দিদিমা ঘিয়ে চিনি দিয়ে শুকনো আটা ভাজতেন। বিকেলবেলা চায়ের সঙ্গে সকলকে দিতেন। মা কখনও কখনও বাসি রুটি শেষ করার জন্য টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে নানা রকম সব্জি দিয়ে সকালবেলা রুটির পোলাও বানিয়ে দিতেন। আমার এক প্রাক্তন প্রেমিক ছিল বীরভূমের।

খুব শখ করে একবার বলেছিল, ‘‘তোমরা কলকাতার লোক, অনেক খাবারের নামই জানো না। আমরা শীতকালে ধুকি খাই, তোমায় করে খাওয়াব।’’ খেয়ে দেখলাম, ওমা! এত আমি ছোট থেকে খাই। ঠাকুমা বানাতেন। চাল দিয়ে সরা পিঠে। বীরভূমের লোক খায় মাংস বা তরকারি দিয়ে। আমরা খেতাম কৃষ্ণনগরের ঝোলা খেজুরের গুড় দিয়ে। এমন অনেক খাবার আমাদের গ্রাম বাংলার ছত্রে ছত্রে পাওয়া যাবে।

একই খাবার নানা নামে নানা জায়গায় প্রচলিত। রান্না করা ভাত জলে ভিজিয়ে সারা রাত ঢাকা দিয়ে রাখতে হয়। সকালে সেটাই হয় পান্তা ভাত। পশ্চিমবঙ্গ, অসম, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশার নানা অঞ্চলে এ অত্যন্ত জনপ্রিয় খাবার। বিশেষ করে গরমকালে। শরীর ঠান্ডা রাখতে মানুষ পান্তা ভাত খোঁজেন। প্রত্যেকটা অঞ্চল নিজের মতো নামকরণ করে নিয়েছে এই খাবারের। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ প্রচলিত প্রবাদে আমরা এটাকে গরিবের খাবার বলেই জানি। অথচ, অসমে বিয়ের দিন সকালে কনেকে এই ভাত দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। বাংলাদেশে নববর্ষে এই খাবারই প্রথম পছন্দ অনেকের। কিন্তু ভূমধ্যসাগরীয়, ফরাসি, পশ্চিম এশীয় কুইজিনের ভিড়ে যে আন্তর্জাতিক রান্নার প্রতিযোগিতায় পান্তা ভাতও জায়গা করে নিতে পারে, তা শেখালেন কিশ্বরই।

বাঁচার জন্য খাওয়া, না খাওয়ার জন্য বাঁচা? বেশির ভাগ খাদ্যরসিক বাঙালি দ্বিতীয়টাই বেছে নেবেন। আমি বরাবরই খাদ্যরসিক। ভাল রান্না না হলে চলবে না, শহরে ঘুরে বিখ্যাত খাওয়ার জায়গাগুলো নিয়মিত ঢুঁ মারব, যত পারি নতুন রান্না চেখে দেখব— এই অভ্যাসগুলো অনেক ছোট থেকেই। বড় হওয়া কলকাতাতেই। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-চাকরি, সবই এই শহরে। কোনও দিনও হস্টেলেও থাকিনি। তাই ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত রান্নাঘরে ঢোকার কথা মনে হয়নি। খেতে যত ভালবাসি, রান্না করতে তত নয়। তবে কর্মসূত্রে যখন বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা হলাম, তখন প্রয়োজন পড়ল। অফিসের ক্যান্টিনে একদিন কারিপাতা দিয়ে চাউমিন খেতে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম, রান্না শিখতেই হবে। শুরু করেছিলাম পাস্তা, গ্রিল্‌ড চিকেনের মতো সহজ রান্না দিয়ে। আলুসিদ্ধ, ডাল ভাত, ডিমের ঝোল দিয়ে বেশির ভাগ দিন চালিয়ে নিতাম।

বাঙালি রান্না তখনও সে ভাবে শুরু করিনি। মনে হতো, খুব কঠিন বুঝি! কিন্তু অফিসে মাঝেমাঝে ‘পটলাক’-এর চল ছিল। যে কোনও একটি পদ রান্না করে আনবেন টিমের প্রত্যেকে, একসঙ্গে খাওয়া হবে। প্রথম পটলাকে বাইরে থেকে অর্ডার করে খাবার নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু দেখলাম টেবিলে কুর্গ, কেরল, সিকিম, রাজস্থান— প্রত্যেক প্রদেশের খাবার। যে যার নিজস্ব রান্না করে এনেছে। সেই প্রথম ইচ্ছে হল আমিও বাঙালি খাবার খাওয়াব। প্রথম বানিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম সর্ষে দিয়ে ভাপা চিংড়ি।

সকলে এত প্রশংসা করেছিল যে তারপর থেকে নেশার মতো হয়ে গেল। মটন কষা, আলু পোস্ত, পাবদার ঝাল, মাছের মাথা দিয়ে ডাল, মুড়িঘণ্ট, আমের চাটনির মতো নানা পদ খাইয়েছিলাম সকলকে। কসমোপলিটান আবহে বাঙালি রান্নার প্রশংসা পেয়ে যে তৃপ্তি পেতাম, তা আর কখনও পাইনি। একবার সহকর্মীরা আবদার জুড়ল শুঁটকি মাছ বানাতে। আমি নাক শিটকে বলেছিলাম, ‘‘ওসব বাঙালরা খায়।’’ সহকর্মীরা অবাক হয়ে বলেছিল, ‘‘আমাদের কাছে তো তুই বাঙালি। অন্য কিছু বুঝি না!’’ সে দিন সত্যিই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম।

কিশ্বরের পান্তা ভাত রান্না করায় ঠিক তেমনই একটা অনুভূতি হল। খাবার আসলে একটা অনুভূতি। তাতে আন্তরিকতার ছোঁয়া থাকলে অনেক কিছু জয় করা যায়। সূত্রঃ আনন্দবাজার