কঠোর লকডাউনে বাবুনগরীর “নৈশবিহার”

| আপডেট :  ৬ জুলাই ২০২১, ০৮:৫৫ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ৬ জুলাই ২০২১, ০৮:৫৫ পূর্বাহ্ণ

বিষয়টি আসলে বেশ অস্বস্তিকর। না, ভুল বলা হচ্ছে। বিষয়টি যতটা না অস্বস্তিকর, তারচেয়েও বেশি অস্বস্তিকর হচ্ছে এর পেছনে যিনি আছেন, তার নামটি। সারাদেশে চলছে কঠোর লকডাউন। যেখানে সাধারণ মানুষ তাদের জীবিকার জন্যই ঠিকমতো ঘরের বাইরে বের হতে পারছে না, ঠিক সেখানে হেফাজত ইসলামের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী নগরে নৈশবিহারে বের হচ্ছেন যেন! কী বিষয়ে কথা হচ্ছে, কেন তিনি তার দলের শীর্ষ নেতাদের সাথে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে দেখা করছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন করলে মুখে কুলুপ এঁটে থাকছেন।

গত সোমবার (৫ জুলাই) রাত ৮টা ৩৭ মিনিটে মন্ত্রীর ধানমন্ডির বাসায় যান হেফাজতের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী। তার নেতৃত্বে আরও উপস্থিত ছিলেন মহাসচিব মাওলানা নুরুল ইসলাম জিহাদি ও হেফাজতের প্রয়াত আমির শাহ আহমদ শফীর একান্ত সহকারী শফিউল আলম। প্রায় ২ ঘণ্টার বৈঠকে শেষে রাত সাড়ে ১০টার দিকে তারা বের হয়ে যান। তারা বেরিয়ে যাওয়ার সময় গণমাধ্যমের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি।

এবার একটু জুনায়েদ বাবুনগরীর অতীতের দিকে যাওয়া যাক-
২০১০ সালে বাবুনগরীকে মহাসচিব করে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
২০১৩ সালের ৫ মে ফজরের নামাযের পরই ঢাকার প্রবেশপথগুলো দখলে নিয়েছিলেন হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা। ঢাকার উত্তরে গাবতলী বাস টার্মিনাল, টঙ্গী এবং দক্ষিণে সায়দাবাদের কাছে কাঁচপুর ব্রিজসহ রাজধানীকে ঘিরে ছয়টি প্রবেশমুখেই অবরোধ তৈরি করেছিলেন হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে সারাদেশ থেকে আসা বিভিন্ন কওমি মাদ্রাসার হাজার হাজার ছাত্র-শিক্ষক।

বেলা বাড়ার সাথে সাথে অবরোধকারীদের মাঝে উত্তেজনা ছড়াতে থাকলো, যখন এর নেতৃত্ব ঢাকার ভিতরে প্রবেশ করে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলো। তখনকার টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা আশা করি পাঠক এখনও ভুলে যাননি। শাপলা চত্বরে তাণ্ডব থেকে শুরু করে সর্বশেষ দেশের বিভিন্ন স্থানে হেফাজতে ইসলামের সহিংসতার নেপথ্যে ছিল সরকার উৎখাত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল।

২০১৭ সালে এসে বাবুনগরী ১৪ সেপ্টেম্বর হাটহাজারী মাদ্রাসায় ছাত্র আন্দোলনের সূচনা হয়। এই আন্দোলন তীব্র হতে থাকলে ১৭ সেপ্টেম্বর মাদ্রাসার মহাপরিচালক শাহ আহমদ শফী স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে মাদ্রাসার দায়িত্ব মজলিসে শুরাকে দিয়ে দেন। ওই দিন তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তীতে বাবুনগরীসহ তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটি গঠিত হয়। তিনি মাদ্রাসার শায়খুল হাদিস ও শিক্ষা সচিব হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন।

২০২০ সালের ২ অক্টোবর এক সভায় এসে বাবুনগরী এক সভায় বলেন প্রয়োজনে আরও দশটা লং মার্চ করতেও তিনি রাজি আছেন। বিদআত, শিরককারী, কাদিয়ানি এদের বরদাস্ত করা হবে না বলে তিনি আরও দশটি লংমার্চ করার জন্য প্রস্তুত আছে বলে জানান।

এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথার বিপরীতে কথা বলেও তিনি একধরণের সমস্যা তৈরির চেষ্টা করেন। নারীদেরকে বোরখা পরার জন্য একধরণের বাধ্যতামূলক কথা বলেন বাবুনগরী। নাস্তিকদের দেশ থেকে বিতারিত করবার জন্যও তিনি কঠোর ভাষায় এমন কিছু কথা বলেন, যা বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের মাঝে বিদ্বেষ ও রোষ প্রচারণার নামান্তর।

সরকারকে চাপে ফেলার জন্য হেন প্রতিহিংসামূলক এবং উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ডের চিন্তা নেই, যা বাবুনগরীর উর্বর মস্তিষ্ক থেকে প্রস্ফুটিত হয়নি। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে হেফাজত কঠোর হরতাল ও আন্দোলনের ডাক দেয়। যেখানে সুবর্ণজয়ন্তীর আনন্দে নগরবাসীর আনন্দে মশগুল থাকার কথা, সেখানে রাজধানীকে ভূতুড়ে নগরীতে পরিণত করে জুনায়েদ বাবুনগরী। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আগমনকে কেন্দ্র করে নানা ইস্যু তৈরি করা হয় এবং ইন্ধন জোগায় হেফাজতে ইসলাম। এমনকি রক্তের বদলা নেয়ার মতো প্রতিহিংসামূলক বাণীও শোনা যায় জুনায়েদ বাবুনগরীর উদাত্ত কন্ঠে।

সে-ই জুনায়েদ বাবুনগরী যখন কঠোর লকডাউনের মাঝে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ান শহরে, সেক্ষেত্রে একটু অস্বস্তিতেও পড়তে হয় বৈকি। কারণ, তার মস্তিষ্কে কী চলছে, তা ঠাহর করা বেশ মুশকিল। গণমাধ্যমের সাথেও কথা বলতে নারাজ ছিলেন তিনি। বৈঠকে অংশ নিতে সোমবার চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছেন জুনায়েদ বাবুনগরী। এরপর তিনি রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার একটি মাদরাসায় বিশ্রাম নেন। এরপর সেখান থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যান। মধ্যাহ্ন ভোজনের পর বিশ্রাম নিতেও কসুর করেন না। তার কর্মকাণ্ড দেখলে নগরবাসীর অবাক হতে হয়, এই বাবুনগরী কি আসলে আইনের নীতির তোয়াক্কা করেন না?

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফোন করে দেখা করার অনুমতি চাইলে তাকে অনুমতি দেয়া হয়। বৈঠকে বাবুনগরী উল্লেখ করেন কওমি মাদ্রাসা খুলে দেয়ার কথা, মাদ্রাসাদের শিক্ষার্থীদের কুরবানীর ঈদের সময়ে চামড়া সংগ্রহের কাজে সহায়তা করার কথা ইত্যাদি। বাবুনগরীর কর্মকাণ্ড দেখলে মনে হয় তিনি এলাম, কথা বললাম, চলে গেলাম- এমন একটি অবস্থায় নিজেকে ভাবছেন। যখন ইচ্ছা আসা, যখন ইচ্ছা চলে যাওয়া- এসবের মধ্যেই আছেন তিনি। দেশে যে চলমান একটি পরিস্থিতি চলছে, সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে, এটি নিয়ে কিছু বলা তো দূরে থাক, বিধিনিষেধেরও কোনো তোয়াক্কা করেন না বাবুনগরী। কী এমন জরুরী প্রয়োজন ছিল বাবুনগরীর? সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতেও কেন তিনি অনীহা প্রকাশ করলেন?

প্রশ্ন অনেক। উত্তরের খোঁজে আছে দেশ। উত্তরগুলো আশু পাওয়াটাই সবার জন্য মঙ্গল, বিশেষ করে দলটির নাম যখন হেফাজতে ইসলাম আর নেপথ্যে জুনায়েদ বাবুনগরী! সূত্রঃ বাংলা ইনসাইডার