যেভাবে গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে ‘কৌশলে’ কালক্ষেপণ করছে ইভ্যালী

| আপডেট :  ৪ জুলাই ২০২১, ০৩:০৭ অপরাহ্ণ | প্রকাশিত :  ৪ জুলাই ২০২১, ০৩:০৭ অপরাহ্ণ

গ্রাহকের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, সময়মতো পণ্য সরবরাহ করতে ব্যর্থ হওয়ার পর বিকল্প সমাধান হিসেবে গ্রাহকদের টাকা রিফান্ড করতে ইভ্যালী আট মাস পর্যন্ত দেরি করেছে। এ সময় প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকের টাকা বিকল্প ব্যবসার পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করেছে।

একজন গ্রাহক ইভ্যালীর কাছ থেকে পাওয়া রিফান্ড চেক দেখিয়েছেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে। ওই গ্রাহক জানিয়েছেন, তারা এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে অর্ডার দিয়েছিলেন, অথচ তাকে একটি রিফান্ড চেক ইস্যু করা হয়েছে আগস্টের ১১ তারিখ দিয়ে।

ইভ্যালীর ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসায় মডেল নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর থেকে অনেক গ্রাহক প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে পাওয়া পোস্ট-ডেটেড রিফান্ড চেক বিক্রি করে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্ট অনুযায়ী, চেক ইস্যু করার তারিখ থেকে ইভ্যালী এক মাস সময় পাবে টাকা পরিশোধের জন্য। অর্থাৎ যে ক্রেতা ফেব্রুয়ারিতে অর্ডার দিয়েছিলেন, তিনি সেপ্টেম্বরের আগে রিফান্ড পাবেন না।

এই কৌশলী রিফান্ডের বদৌলতে ইভ্যালী গ্রাহকদের টাকা আট মাস আটকে রেখে মূলধন হিসেবে ব্যবহার করতে পারছে। এর বদলে প্রতিষ্ঠানটিকে যদি ব্যাংক লোন নিয়ে কার্যক্রম চালাত হতো, তাহলে তাদেরকে ৭ থেকে ৯ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিতে হতো।

এভাবেই বর্তমান ইভ্যালীর সম্পদের তুলনায় দেনা অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। ফলে প্রতিষ্ঠানটি খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ছে।
বিশাল ছাড়ের লোভে ইতোমধ্যে পণ্যের জন্য টাকা পরিশোধ করে দেওয়া অনেক গ্রাহক ভিড় জমাচ্ছেন ইভ্যালীর অফিসে।
এই ক্রেতাদের দলে আছেন মৌলভীবাজারের দোকানদার মাসুদ পারভেজ। তিনি এখন তার পুঁজি ফিরে পেলেই খুশি।

মাসুদ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রায় ৪০% ছাড়ে একটি ১৬০সিসি মোটরসাইকেল অর্ডার করেছিলেন। ইভ্যালীর প্রতিশ্রুতি ছিল, ৪৫ কর্মদিবসের মধ্যে মোটরসাইকেলটির ডেলিভারি দেওয়া হবে। কিন্তু কয়েক মাস পরে, স্টক সমস্যার কথা বলে ইভ্যালী তাকে এমআরপিতে রিফান্ডের জন্য একটি চেক ইস্যু করে। কিন্তু এ বছরের আগস্টে চেকটি ভাঙাতে হবে।

চেক ভাঙানোর জন্য মাসুদ উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর যখন জানতে পারলেন ক্রমাগত লোকসান দিতে থাকা ইভ্যালীর দেনার পরিমাণ তাদের সম্পদের চেয়ে ছয়গুণ বেশি, তখন সে আশা ছেড়ে দিয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, গ্রাহক ও মার্চেন্টদের কাছে ইভ্যালীর দেনার পরিমাণ ৪০৩.৮০ কোটি টাকা যেখানে কোম্পানিটির চলতি সম্পদ মাত্র ৬৫.১৭ কোটি টাকা।

মাসুদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ‘আমার টাকা সময়মতো ফেরত পাব কি না জানি না। এখন এই চেকের বিনিময়ে কেউ যদি অর্ডার করার সময় যে টাকা পরিশোধ করেছিলাম সে পরিমাণ টাকা দেয়, তাহলেই আমি খুশি।’

ঢাকার বাসিন্দা আহসানুল কবির গত সপ্তাহে ইভ্যালী থেকে পাওয়া চেক ব্যাংকে জমা দিয়েছিলেন, কিন্তু ইভ্যালীর অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় চেকটি বাউন্স করেছে।

এ ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন আহসানুল। তবে পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠানটি এসএমএস পাঠিয়ে গ্রাহকদের পরের সপ্তাহে চেক ভাঙাতে বললে মাসুদ কিছুটা স্বস্তি পান।
ইভ্যালী অনলাইন ব্যবহারকারীদের গ্রুপে বেশ কয়েকটি বিক্রয় পোস্ট দেখে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এর এই প্রতিবেদকরা।

ইমরান খান নামে একজন ইভ্যালী গ্রাহক গত সপ্তাহে ‘ইভ্যালী প্রোডাক্ট বাই সেল অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ—অল বাংলাদেশ’ নামক গ্রুপে ৩ লাখ নগদ টাকার বিনিময়ে ৩ লাখ ২৮ হাজার টাকার চেক বিক্রির পোস্ট দেন। চেকটি ভাঙানোর তারিখ দেওয়া হয়েছে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে।

কিন্তু এই দামে পোস্টে কোনো সাড়া পাননি ইমরান।
পরবর্তীতে কাজী আবু নাসের নামে ওই গ্রুপের আরেক সদস্য ওই পোস্টে সাড়া দিয়ে জানান, চেক ভাঙানোর সময় ইমরানের কাছ থেকে পূর্ণ সহযোগিতার শর্তে ২ লাখ ২০ হাজার টাকায় তিনি চেকটি নিতে রাজি আছেন।

ইভ্যালীতে আটকে থাকা অর্ডার নিয়ে গ্রাহকরা ভীষণ চিন্তিত। কেউ কেউ অবশ্য আশা করছেন, প্রতিষ্ঠানটি আবার ঘুরে দাঁড়াবে।
তবে ইভ্যালী গ্রাহক ফয়সাল হোসেন অবশ্য আশাবাদী । অনিশ্চয়তার কাছে আত্মসমর্পণ করতে নারাজ তিনি।

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, ‘আগেও এরকম বিপর্যয় দেখেছি। প্রতিবারই আশাবাদী ছিলাম। এবারও আমার আশা, কোম্পানিটি এই বছরের অক্টোবরের মধ্যে আমার টাকা ফেরত দিতে পারবে।’
ইভ্যালীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রাসেল অবশ্য স্বীকার করেননি যে, তার গ্রাহকরা আতঙ্কে আছেন।

তিনি দাবি করেছেন, ‘এরকম গ্রাহক খুবই কম। বেশিরভাগ গ্রাহকই তাদের অর্ডার নিয়ে আত্মবিশ্বাসী। আর বিশ্বস্ত গ্রাহকরা আমাদের ব্রেক-ইভেন গোলকে সমর্থন দেবার জন্য আমাদের রেগুলার শপে অর্ডার করছেন।’

প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের টাকা রিফান্ড করছে কেন জানতে চাইলে রাসেল বলেন, ‘বেশিরভাগ অর্ডারই সময়মতো ডেলিভারি দেওয়া হয়েছে। মহামারির কারণে সাপ্লাই চেইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় আমাদের স্টকে ঘাটতি পড়ে। সে কারণে অল্পকিছু অর্ডার সময়মতো ডেলিভারি দিতে পারিনি। এজন্য ওইসব অর্ডারের টাকা ফেরত দিচ্ছি।’

তাহলে, ৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে যে পণ্য পৌঁছানোর কথা, সেটি পৌঁছাতে ৬ মাস পর্যন্ত দেরি হলো কেন? এ প্রশ্নের জবাবে রাসেল বলেন, ‘যেসব গ্রাহক প্রকৃত রিফান্ড অ্যামাউন্ট গ্রহণ করেননি, আমরা তাদের টাকা এমআরপিতে ফেরত দিচ্ছি। সেক্ষেত্রে আমাদেরকে ফান্ড এবং মূলধন আনতে হয়। এজন্যই বাড়তি সময় লাগছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে যখন জানা গেল বর্তমান দেনার বিপরীতে কোম্পানিটির ব্যাংক হিসেবে কার্যত কোনো টাকা নেই, তখনই প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি হওয়ার ঝুঁকির কথা ভেবে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন গ্রাহকরা। ব্যবসায়ীদের কাছে ইভ্যালীর দেনা ১৯০ কোটি টাকা এবং গ্রাহকদের কাছে দেনা ২২৪ কোটি টাকা।

সরকার যখন ঘোষণা করে যে পণ্য সরবরাহ করার আগ পর্যন্ত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো টাকা বুঝে পাবে না, তখন ধারণা করা হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটির নগদ প্রবাহের অসামঞ্জস্যতা আরও বাড়বে।

অনলাইনে আগে মূল্য পরিশোধ করা পণ্য সর্বোচ্চ ৫ দিনের মধ্যে সরবরাহ বাধ্যতামূলক করেছে সরকার।

এই খাতকে নীতিমালার আওতায় আনার জন্য নেওয়া পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে ইভ্যালীর সিইও দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেছেন, তার প্রতিষ্ঠান নিরবচ্ছিন্নভাবে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য তহবিলের সন্ধান করছে।

‘আমাদের ব্যবসা ও ডেলিভারি চলছে। আমরা নানা উৎস থেকে ধার করতে পারি। আগেও এমন ধার করেছি,’ সম্প্রতি টেলিফোনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন তিনি। তিনি আশা প্রকাশ করেন, আগামীতে তার প্রতিষ্ঠান বেশ ভালো পরিমাণে বিনিয়োগ পাবে।

নতুন অর্থায়নের সম্ভাব্য উৎস প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা দেশ-বিদেশের বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কথা বলছি। আলোচনায় সন্তোষজনক অগ্রগতি হলে আমরা তাদের নাম জানাব।’

তিনি আরও বলেন, ইভ্যালীর সঙ্গে ব্যবসা করে লাভবান হওয়ায় ‘সাপ্লায়ারদের’ আমানত এখনও বাড়ছে। রাসেল বলেন, এর ফলে বড় মূল্যছাড় থেকে নিয়মিত ব্যবসায় ফিরে আসতে যে সময় লাগবে, সেই রূপান্তরকালীন সময়ে পণ্য সরবরাহ ও সেবা চালু রাখতে পারবে ইভ্যালী।

‘কাজেই আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই,’ এই বলে গ্রাহকদের আশ্বস্ত করেছেন রাসেল।

ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াহেদ তমাল বলেছেন, ইভ্যালীর ব্যবসায়িক মডেল আদর্শ ব্যবস্থা নয়। এবং গ্রাহকদেরকে পণ্য সরবরাহ করা ও ব্যবসায়ীদের টাকা পরিশোধ করাও তাদেরই দায়িত্ব।

সূত্রঃ The Business Standard