বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজারে জমজমাট প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস

| আপডেট :  ২৭ জুন ২০২১, ০৭:৪৮ অপরাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২৭ জুন ২০২১, ০৭:৪৮ অপরাহ্ণ

সেই সুদূর অতীতের ঘোড়াচালিত গাড়ি থেকে অন্তর্দহ ইঞ্জিনচালিত গাড়ি আসতে সময় লেগেছিল কয়েক হাজার বছর। প্রাচীন সভ্যতাগুলোয় যে ঘোড়ার গাড়ির যাত্রা শুরু, তা শিল্প বিপ্লবোত্তর সমাজেও টিকে ছিল বহাল তবিয়তে। তার পর বিশ শতকের শুরুর

ধাপে অন্তর্দহ ইঞ্জিন এসে বলা যায় চাকরিহারা করল ঘোড়াদের। অথচ তার পরের এক শতকে পরিবহনের দুনিয়ায় অনেক বদল এসেছে। বদল এসেছে জ্বালানিতে। জন্ম হয়েছে জ্বালানি রাজনীতিরও। এবার এর ছক বদলের পালা। একসময় যে বৈদ্যুতিক গাড়িকে শৌখিন মনে হতো, এখন সেই বৈদ্যুতিক গাড়িই হয়ে উঠছে বাস্তবতা। বাড়ছে এর বাজার; সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা।

জীবাশ্ম জ্বালানির মাধ্যমে চালিত গাড়ি থেকে বৈদ্যুতিক গাড়ি বাস্তবতায় আসতে হিসাবে কম সময়ই লেগেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যানবাহনের যে বিবর্তন হয়েছে, তা ব্যক্তিগত পরিবহনের ধারণাই দিয়েছে বদলে। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের তথ্য বলছে, ২০২০ সালে কোভিড–১৯ মহামারির কারণে বৈশ্বিকভাবে হালকা যানবাহনের বিক্রি কমলেও চলতি বছর তা বাড়বে। এরই মধ্যে সে প্রবণতাও দৃষ্টিগ্রাহ্য হচ্ছে।

বাজার ও ভোক্তা তথ্য বিশ্লেষক ও জরিপকারী প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টার তথ্যমতে, ২০২০ সালে কোভিড পরিস্থিতির কারণে ব্যক্তিগত যানবাহনের বিক্রি সারা বিশ্বেই আগের বছরের তুলনায় ২০ শতাংশ কমে গিয়েছিল। কিন্তু চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকেই হালকা যানবাহনের বিক্রির হার বাড়তে শুরু করেছে। এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা অঞ্চলে এই প্রবণতা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

নতুন দুনিয়ায় বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকটের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিগত যানবাহনের ক্ষেত্রে বৈদ্যুতিক গাড়ির কদর দিন দিন বাড়ছে। এমনকি এই কোভিড–১৯ মহামারিকালেও বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রির হার বাড়ছে। ভারতীয় বাজার–বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান অ্যালাইড মার্কেট রিসার্চ বলছে, ২০১৯ সালে বৈশ্বিক পরিসরে বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজার ছিল ১৬ হাজার ২৩৪ কোটি মার্কিন ডলারের। বিদ্যমান প্রবণতা বলছে, এ বাজার ২০২৭ সাল নাগাদ ৮০ হাজার ২৮১ কোটি ডলারে গিয়ে পৌঁছাবে।

বিদ্যুৎচালিত যানবাহনের বাজার নিয়ে গত ৭ জুন পিউ রিসার্চ সেন্টার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ির বাজারের ৭ শতাংশ এখন বৈদ্যুতিক গাড়ির দখলে। শুধু তাই নয়, জরিপে অংশ নেওয়া ৩৯ শতাংশই জানিয়েছেন, তাঁরা বৈদ্যুতিক গাড়ি কেনার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছেন।

তবে বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজারের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে। এই বাজার সবচেয়ে বেশি সম্প্রসারিত হচ্ছে চীনে। চীনের গাড়ির বাজারের ৪৪ শতাংশই এখন বৈদ্যুতিক গাড়ির দখলে। এরপরই আছে ইউরোপ। এই অঞ্চলটির বাজারের ৩১ শতাংশ এখন নতুন ধারার এই বাহনের দখলে। তবে চীনের দিকে আলাদা করে নজর দিতেই পারেন ইলোন মাস্ক। কারণ, ২০১৬ থেকে ২০২০ সময় পর্যন্ত সময়ে চীনে বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজার সম্প্রসারিত হয়েছে ৬০ শতাংশ।

ফলে এটা বলা যেতেই পারে যে, বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজারের এই প্রসার ক্রমে অনেক কিছু বদলে দেবে। বিশেষ করে মানুষের ভ্রমণে বড় পরিবর্তন আসবে। বৈদ্যুতিক শক্তিতে চালিত গাড়ির গড়ন জীবাশ্ম জ্বালানি চালিত গাড়ি থেকে আলাদা। ব্যাপারটি যেন চাকার ওপরে কম্পিউটার থাকার মতো বিষয়।

বিদ্যুৎ শক্তি প্রচলিত গাড়ির কাঠামোয় উল্লেখযোগ্য বদল এনেছে। এটা অনেকটা চাকার ওপর কম্পিউটার নিয়ে চলার মতো বিষয়। সম্পূর্ণ নতুন ধরনের এই বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার কারণে এসব গাড়ি শুধু স্বচালিতই নয়, এটি বিপুল পরিমাণ তথ্যও উৎপন্ন করে। একই সঙ্গে নতুন নতুন ব্যবসার দ্বারও এটি উন্মোচন করছে। অভ্যাসে আনছে বদল। এই বদল কোন মাত্রা পর্যন্ত পৌঁছায়, তা সময়ই বলে দেবে।

বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজারে এরই মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়তে শুরু করেছে। টেসলাসহ বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এখন এই বাজারের দখল নিতে লড়াই করছে। গড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান টেসলা শুধু নিজে নয়, ছোট ছোট ও নতুন প্রতিষ্ঠানগুলোকেও তারা বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরিতে উৎসাহিত করছে। করছে আর্থিক সহায়তাও। টেসলার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইলোন মাস্ক এরই মধ্যে বছরে ২ কোটি বৈদ্যুতিক গাড়ি বাজারে ছাড়ার সক্ষমতা অর্জনের স্বপ্ন দেখেন। এখনো অবশ্য তিনি তাঁর স্বপ্ন থেকে বহু দূরে আছেন। ২০১৯ সালে যেমন তিনি বাজারে আনতে পেরেছেন ৩ লাখ ৭০ হাজার বৈদ্যুতিক গাড়ি।

ফলে স্বপ্ন বাস্তবায়নই এখন টেসলার মতো প্রতিষ্ঠানের বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে আছে। আর এ জন্যই প্রতিষ্ঠানটি ছোট ও নতুন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজের দলে ভেড়াতে চাইছে। সঙ্গে নতুন নতুন কারখানাও বানাচ্ছে তারা। টেক্সাস বা বার্লিনে যেমন, তেমনি সাংহাইয়ে নতুন কারখানা খোলাটা অন্তত তারই প্রমাণ বহন করে।

টেসলার এই উদ্যোগে অনেকেই সাড়া দিচ্ছে। কিন্তু তারা সফটওয়্যার তৈরি নিয়ে সবচেয়ে বড় সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। বৈদ্যুতিক গাড়ির অন্যতম অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে এই সফটওয়্যার। শুধু ব্যাটারি আর মোটরকে ইঞ্জিনের সঙ্গে জুড়ে দিলেই এখানে চলে না। টেসলা তার গাড়ি ব্যবহারকারীদের তারহীন একটা বিদ্যুৎ সংযোগের অভিজ্ঞতা দিতে চায়। এটিই আবার বড় সংকট তৈরি করছে নতুন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য।

বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে গাড়ির সংযোগ তৈরি থেকে শুরু করে গাড়িতে থাকা সফটওয়্যারের নতুন নতুন আপডেট নিশ্চিত করাটা অতটা সহজ নয়। মনে রাখা দরকার টেসলা যে বৈদ্যুতিক গাড়ির ধারণা নিয়ে এসেছে, তাকে আদতে একটি স্মার্টফোনের সঙ্গে তুলনা করা যায়। আমাদের পরিচিত স্মার্টফোনের সঙ্গে এর পার্থক্য শুধু এই যে, এটি আমাদের বহন করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে পারে।

দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, বৈদ্যুতিক গাড়ি আধুনিক মানুষের মধ্য ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে। এই জনপ্রিয়তা কিছু চ্যালেঞ্জও সামনে হাজির করেছে। কারণ, এখনকার দুনিয়ায় গাড়ি শেয়ার খুব সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এ জন্য বহু অ্যাপও আছে বাজারে। এর মধ্যে উবার, লিফট, পাঠাও ইত্যাদির কথা উল্লেখ করা যায়। সাধারণ মানুষের মধ্যেও এর একটা চাহিদা তৈরি হয়েছে, যা পূরণের চ্যালেঞ্জ বৈদ্যুতিক গাড়ির নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও নিতে হবে। এদিকে বৈদ্যুতিক গাড়ির জন্য ইঞ্জিনের সরবরাহ পেতে ইঞ্জিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরিও একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

তবে এই সব চ্যালেঞ্জকে উতরে যাওয়ার ইঙ্গিত বেশ স্পষ্ট। বড় বড় বিনিয়োগ আসছে। এ ক্ষেত্রে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের চিত্র প্রায় একই রকম। চীনে যেমন লি, নিও, ডব্লিউএম মোটর ও এক্সপেং, যুক্তরাষ্ট্রে তেমন ফিস্কার, লুসিড ও নিকোলার মতো

প্রতিষ্ঠান এই দৌড়ে শামিল হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ হচ্ছে। ফলে বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজারে নিজেদের হিস্যা বুঝে নিতে নতুন ও পুরোনো প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে লড়াই জমে উঠবে নিশ্চিতভাবে। এ লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত কে জয়ী হয়, তা এখনই বলার সুযোগ না থাকলেও একটা জমজমাট লড়াই যে অপেক্ষায় আছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।