অসহায় বাবার উচ্চশিক্ষিত ছেলেকে লেখা চিঠি; আমি বৃদ্ধাশ্রম থেকে বলছি

| আপডেট :  ২৫ জুন ২০২১, ০৬:০৬ অপরাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২৫ জুন ২০২১, ০৬:০৬ অপরাহ্ণ

অসহায় বাবার উচ্চশিক্ষিত ছেলেকে লেখা চিঠি – প্রিয় সোনামানিক, তুমি কেমন আছ একথা জিজ্ঞাসা করা সম্পূর্ণ নিরর্থক মনে করছি। তুমি ভাবছ হয়ত তোমা’র বাবা আগের মত তোমায় ভালোবাসে না। যদি এটা ভেবে থাক তবে তোমা’র

সেই ছোট্টবেলার মত আরেকটি ভুল করলে। আমি মনে প্রাণে বিশ্বা’স করি তুমি পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভালো আছ কেননা আমর’া দোয়া যার সাথে সর্বদা জড়িয়ে থাকে সে খারাপ থাকতে পারে এটা আমি বিশ্বা’স করিনা। আমা’র বউমা এবং প্রিয় দাদুভাইয়েরাও ভালো আছে বলে বিশ্বা’স। আমি কোন মেয়ের বাবা ‘হতে না পারলেও তোমাকে বিবাহ দিয়ে যে

লক্ষ্মী বউমাকে পেয়েছিলাম তাকে কোনভাবেই কষ্ট দিবে না। লক্ষ্মী মেয়েটি আমা’র মেয়ের শুণ্যস্থান পুর্ণ করে দিয়েছে! আমা’র নাতী-নাতনীদের অনেক অনেক আদর দিও এবং তাদের কোন চাওয়া অ’পূর্ণ রাখবে না। তোমা’র ‘হতভাগ্য-‘হতদরিদ্র জন্ম’দাতা তোমা’র চাহিদা তো দূরের কথা মৌলিক চাহিদাও সম্পূর্ণভাবে পূর্ণ করতে পারেনি কিন্তু তুমি তো

গরীব নও। সুতরাং ছেলে-মেয়ের কোন শখ যেন অ’পূর্ণ না থাকে। তোমা’দের দোয়ায় আমিও অনেক ভালো আছি। পাশের রুমের গণি মিয়া আমা’র সূখ দেখে ঈর্ষা করে কেননা তুমি প্রতি বছর দু’ইবার আমা’র কাছে ছুটে আস। তোমা’র ব্যস্ততা রেখে তোমাকে আসতে বারবার নিষে’ধ করি তারপরও তুমি কেন আস তা আমি বুঝতে পারি না। এটা

ভেবোনা যে, তুমি না আসলে আমি তোমায় ভুলে যাব’ কিংবা কম দোয়া করবো বরং তোমা’দের প্রতি দোয়ার পরিমাণ দিন দিন বাড়তেই থাকবে। কেননা দিন দিন যেভাবে অক্ষম হয়ে যাচ্ছি তাতে আমা’র পৃথিবীটা সংকুচিত ‘হতে ‘হতে আমা’র এক চোখ ভাঙা চশমাটির মত হয়ে দাঁড়িয়েছে। আফসুস বেচারা গণি মিঞার জন্য! ওর সন্তানগু’লো ওকে এখানে রেখে যাওয়ার পর একবারও খোঁজ নেয়নি; শুধু টাকা পাঠানো ছাড়া। প্রিয় পুত্রধন! জীবন সায়াহ্নে এসে বারবার অনুশোচনা হচ্ছে। মনে

হচ্ছে, কোথাও যেন আমি চরম ভুল করেছি। তোমাকে লালন-পালন করতে গিয়ে কোথায় যেন আমি আমা’র দায়িত্ব ঠিকমত পালন করতে পারিনি। তোমা’র মা আর আমি তোমাকে বাইরে রেখে জীবনের কোন পরিকল্পনা সাজাই নি অথচ আজ যেন নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। তোমা’র কাছে হয়ত এটাই আমা’র শেষ চিঠি তাই কিছু কথা বলে যাওয়া আবশ্যক। এত তাড়াতাড়ি মর’ে যাব’ো সেটা মনে হচ্ছে না কেননা আমি চাইলেই তো আর মৃ’ত্যু আমাকে ধ’রা দেবে না

কিন্তু লিখতে বসলে চোখ যেভাবে ঝাপসা হয়ে আসে, হাত যেভাবে কাঁপতে শুরু করে কিংবা মস্তিষ্ক যেভাবে আমা’র বিরু’দ্ধাচারণ করে তাতে তোমাকে আর লিখতে পারবো বলে মনে হয়না। তাই জীবনের শেষ কথাগু’লো আজকেই বলে দিব। ভেবোনা, আমি তোমাকে কৈফিয়তের কাঠগোড়ায় দাঁড় করাবো। মর’ন সমুদ্রের বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে, সন্তান হিসেব তুমি ‍সুসন্তানের সম্পূর্ণ দায়িত্ব পালন করলেও আমি পিতা হিসেবে মোটেও সফল নই। বৃ’দ্ধাশ্র্রম নিয়ে সমাজে

বহু ধরণের খারাপ কথা প্রচলিত থাকলেও আমি সেটা মনে করিনা। তুমি আমাকে জোড় করে বৃ’দ্ধাশ্রমে পাঠাও নি বরং আমিই তোমা’র চোখের জলের বিরু’দ্ধাচারণ করে এখানে আশ্রয় নিয়েছি। আব্বু, তোমা’র হয়ত মনে নাই কিন্তু শুধু তোমা’র লেখাপড়ায় যাতে ব্যাঘা’ত না ঘটে সেই কথা ভেবে আমা’র পক্ষের প্রায় সকল আ’ত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক শিথিল করে ফেলেছিলাম। তোমা’র মা তোমা’র নানা-নানীর একমাত্র মেয়ে হয়েও তাদের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল শুধু

তোমা’র উজ্জ্বল ভবি’ষ্যতের চিন্তায়। আমি এবং তোমা’র মা-আমা’দের উদ্দেশ্যে সফল হয়েছি। দেশের মাত্র কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম যদি উচ্চারিত হয় তবে সেখানে আমা’দের সোনমানিকের নামটিও উচ্চারিত হয়। এটা কি আমা’দের কম আনন্দের-কম পাওয়া। এত হিসেব করে তোমাকে মানুষের মত মানুষ করা এই বৃ’দ্ধ যদি আজ আমা’র দাদুভাইদের উজ্জ্বল ভবি’ষ্যতের অন্তরায় ঘটায় তবে সেটা বেমানান বটে! এখানে যে ছেলেটা আমা’দের দেখাশুনা করে সে ছেলেটার

মত ছেলে খুব কম দেখা যায়। ওর সম্পর্কে বললে তোমা’র মনে হবে এই জগতেও এমন বোকা ছেলে আছে! সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা কিংবা গভীর রাতে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞাসা করে, কাকা! কিছু লাগবে? ওর আচরণে তোমা’র অনুপস্থিতিতে বুকের মধ্যের শূন্যতা কেমন যেন পূণ্য হয়ে যায়। ছেলেটা খুব গরীব। দিনরাত পরিশ্রম করে এখান থেকে যা মাইনে পায় তা দিয়েই ওর বাবা-মা এবং স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে চলতে হয়। আমি মনোযোগ দিয়ে ওর কষ্টের কথা শুনি; আমা’র

মত অক্ষম-অলসের এর বাইরে তো আর কোন কাজ থাকে না। আমা’র ইচ্ছা হয় ওকে কিছু বাড়তি টাকা দেই। কিন্তু আমা’র সে সাধ্য তো নাই। ছেলেটাকে বলেছিলাম ওর বাবা-মাকে এই বৃ’দ্ধাশ্রমে নিয়ে আসতে। এ কথাশুনে ছেলেটা হাউমাউ করে কেঁদে দিয়ে বলেছে, র’ক্ত বিক্রি করে হলেও বাবা-মাকে নিজের কাছে রাখবে; কোনদিন বৃ’দ্ধাশ্রমে দিবে না। ছেলেটার কথা শুনে ভেতরটা হঠাৎ মুচড়ে গিয়েছিল কিন্তু ক্ষণিক পরেই বুঝলাম আমি হয়ত আবেগাপ্লুত হয়ে

যাচ্ছি! তাই এ নিয়ে আর ও ছেলেটার কাছে কিছু বলতে যাইনি। অল্পশিক্ষিত একটি ছেলে তার বাবা-মাকে নিয়ে যা ভাবছে সেটা কেবল আবেগের কথা! তোমর’া যারা উচ্চশিক্ষিত তারা আবেগকে প্রশ্রয় দিবে কেন? আব্বু! আগামী বার আমাকে যদি দেখতে আসো তবে আমা’র কলিজারটুকরো প্রাণপ্রিয় দাদুভাইদের নিয়ে এসো। আমি দেখতে চেয়েছি শুনলে ওরা আসতে চাইবে। বউমাকে এতদূর আনার দরকার নাই। মামনী আমা’র গরম সহ্য করতে পারে না। জানি

দাদুভাইদেরও কষ্ট হবে। কিন্তু জীবনে এই শেষবার। আর কোনদিন ওদের দেখতে চাইবো না বলে নিশ্চয়তা দিতে পারছি না কেননা দিন যত সামনে এগু’চ্ছে ততোই আমা’র আচরণগু’লো শিশুদের মত হয়ে যাচ্ছে। পরবর্তীতে যদি কখনো দাদুভাই কিংবা বউমাকে দেখতে চাই তবে সেটা আমা’র শিশু সূলভ খামখেয়ালী ভেবে মূল্যায়নের বাইরে রেখো। আসার সময় বাসা থেকে কিছু রেঁধে আনবে না। এখানে যে খাবার দেয় তার তুলনায় বাসার খাবারগু’লো অনেক খারাপ! অনেক কথাই

লেখার ছিল কিন্তু আর কিছুই লিখতে পারলাম না। কোথা থেকে একটা অন্ধ পোকা এসে আমা’র চোখের মধ্যে ঢুকে পড়লো! কিছুটা যন্ত্রনাও হচ্ছে বটে। অক্ষমবাবাকে ক্ষ’মা করো। তোমা’র সন্তানদের জন্য তুমি যেন আমা’র মত অক্ষম বাবা না হও তার চেষ্টা করো। কয়েকদিন হল তোমা’র মা আমায় খুব জ্বা’লাচ্ছে। তাকে হারানোর ১৫ বছর পর এমনটা কেন ঘটছে তা বুঝতে পারছি না। স্বপ্নে সে কেবল ডেকেই যাচ্ছে। আমা’র আরও অনেকদিন বাঁচতে ইচ্ছা করে এবং বৃ’দ্ধাশ্রমের

খালি ঘরগু’লোতে কারা’ আমা’র বন্ধু হয় তা দেখতে সাধ হয় কিন্তু সে সৌভাগ্য আমা’র হবে না বোধহয়! আমি মা’রা যাওয়ার পর, তোর মায়ের পাশেই আমাকে কবর দিও। এতে কিছুটা যায়গা নষ্ট হবে ঠিক কিন্তু তোমা’র মাকে ছেড়ে আমি দূরে থাকতে পারবো না। আমা’র এ আব্দারটুকু রেখো। রাখবে তো? আমায় ক্ষ’মা করে দিও। তোমা’র অক্ষম জন্ম’দাতা নতুনপল্লী বৃ’দ্ধাশ্রম।