পলাশীর খলনায়িকা ঘসেটি বেগমের শেষ দিনগুলো কেটেছিল ঢাকার যে প্রাসাদে

| আপডেট :  ২৩ জুন ২০২১, ০১:৪৫ অপরাহ্ণ | প্রকাশিত :  ২৩ জুন ২০২১, ০১:৪৫ অপরাহ্ণ

বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা আজ থেকে ২৬৪ বছর আগে যে পলা’শীর যু’দ্ধে হেরে গিয়েছিলেন, তাতেই যে ভারতে ইংরেজদের একচ্ছত্র শাসন প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি হয়, তা ইতিহাসের সাধারণ পাঠেই জানা যায়। ইতিহাস বলছে, যে প্রাসাদ ষ’ড়যন্ত্র সিরাজউদ্দৌলার এই পরাজয়ের পেছনে দায়ী তাতে তাঁর নিজের সে’নাপতি মীর জাফর ছাড়াও যোগ দিয়েছিলেন তাঁর আপন খালা ঘসেটি বেগম।

এই ঘসেটি বেগম ছিলেন পলা’শীর যু’দ্ধে সিরাউদ্দৌলার পরাজয়ের পেছনে একজন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, যার জীবনের শেষ দিনগুলো কে’টেছিল ঢাকার কাছে একটি প্রাসাদে ব’ন্দী অবস্থায়।

পলা’শী যু’দ্ধ পরবর্তীতে তিনিও নিজেও শি’কার হয়েছিলেন প্রাসাদ ষ’ড়যন্ত্রের। এই ষ’ড়যন্ত্রের ফলস্বরূপ বুড়িগঙ্গায় ডুবে করুণ মৃ’ত্যু হয় তার। যড়যন্ত্রকারী হিসেবে বাংলার মানুষের কাছে তিনি বরাবর ঘৃণিত এবং জটিল মা’নসিকতার প্রতীক এক চরিত্র। স্বীকার করতেই হবে বাংলার ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে আছেন তিনি।

জিঞ্জিরা প্রাসাদ:
ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বিবিসিকে বলেছেন, ঘসেটি বেগম ইতিহাসবিদদের মনোযোগ তেমন পাননি, যে কারণে তার ঢাকা জীবন সম্পর্কে তেমন তথ্য পাওয়া যায় না। তার জীবনের শেষ দিনগুলো কে’টেছিল ঢাকার কাছে কেরানীগঞ্জে অবস্থিত জিঞ্জিরা প্রাসাদে।

জাতীয় তথ্য বাতায়ন নামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ওয়েবসাইটে ঢাকা জে’লার দর্শনীয় স্থানের তালিকায় জিঞ্জিরার প্রাসাদকে অন্যতম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে কয়েক’শ গজ দূরে। ওয়েবসাইটে জিঞ্জিরার প্রাসাদকে ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে সেটি কেরানীগঞ্জের স্থানীয় মানুষদের দ’খলে রয়েছে বলে জানা যায়।।

মুনতাসীর মানুন বলেন, জিঞ্জিরা প্রাসাদে ঘসেটি বেগম একা নন, পলা’শী যু’দ্ধের পর নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরিবারের নারী সদস্য অর্থাৎ তাঁর মা, স্ত্রী, কন্যাসহ অনেকজন নারীকেই ব’ন্দি করে পাঠানো হয়েছিল। ১৭৫৭ সালের শেষের দিকে তাদের ওই প্রাসাদে পাঠানো হয়েছিল। ব’ন্দি নারীদের প্রাসাদের বাইরে বের হবার অনুমতি ছিল না। ১৭৬০ সালে পানিতে ডুবিয়ে হ’’ত্যার আগ পর্যন্ত ওই প্রাসাদেই ছিলেন ঘসেটি বেগম।

প্রথমবারের মত ‘মাতৃত্বের ছায়া’
শ্রী পারাবাতের লেখা ‘আমি সিরাজের বেগম’ বইয়ে বলা হয়েছে পলা’শীর যু’দ্ধ শেষ হবার খবর মুর্শিদাবাদে পৌঁছার পরই ঘসেটি বেগম ‘নিজের ভু’ল’ বুঝতে পেরেছিলেন। পরাজিত নবাব তখনো হীরাঝিলে এসে পৌঁছাননি। সে সময় ঘসেটি বেগম নবাব-পত্নী লুৎফাকে সতর্ক করেছিলেন, ‘যেভাবে, যে পথেই তাঁরা পালান, যেন নদীপথে তাঁরা না যান।’

লুৎফা প্রথমবারের মত ঘসেটি বেগমের চোখে মাতৃত্বের ছায়া দেখেছিলেন। তার বয়ানে তিনি বলছেন, ‘হয়ত নিজের ভু’ল বুঝতে পেরেছেন তিনি’। এদিকে মীর জাফর নবাব হবার পরই ঘসেটি বেগমকে ব’ন্দি করেন। কিছুদিন হীরাঝিলে ব’ন্দি রেখে পরে তাকে ঢাকায় বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে জিঞ্জিরা প্রাসাদে স্থানান্তর করেন।

সেখানে তার সঙ্গে সিরাজউদ্দৌলার মা আমিনা বেগমকেও অন্তরীণ করে রাখা হয়েছিল। মৃ’ত্যুর আগ পর্যন্ত তারা দুইজনই ওই প্রাসাদে ছিলেন। তার মৃ’ত্যু নিয়ে দুই রকম তথ্য প্রচলিত আছে। কোথাও বলা হয়েছে, মুর্শিদাবাদে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে তাকে হ’’ত্যা করা হয়েছিল, এবং সেখানেই তার কবর।

কিন্তু বাংলাপিডিয়ায় উল্লেখ করা হয়েছে, ১৭৬০ সালে মীরজাফরের ছেলে মীরনের পরিকল্পনায় ঘসেটি বেগম ও আমিনা বেগমকে পানিতে ডুবিয়ে হ’’ত্যা করা হয়। ঘসেটি বেগম ও আমিনা বেগমকে মুর্শিদাবাদে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার কথা বলে, বুড়িগঙ্গা নদীতে বড় একটি বজরায় তুলে দেয়া হয়। যাত্রা শুরুর কিছু পরে ঘসেটি বেগম এবং আমিনা বেগমকে নিয়ে মাঝনদীতে বজরাটি ডুবিয়ে দেয়া হয়।

মতিঝিল-এর মালিক
বাংলাদেশের জাতীয় এনসাইক্লোপিডিয়া বাংলাপিডিয়াতে ঘসেটি বেগমের জীবনীতে উল্লেখ করা হয়েছে, তার আসল নাম মেহের-উন-নিসা বেগম। তিনি ছিলেন বাংলা, বিহার ও ওড়িশার নবাব আলীবর্দী খানের তিন মেয়ের মধ্যে প্রথম। বড় ভাই হাজী আহমেদের তিন ছেলের সাথে নিজের তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন আলীবর্দী খান।

মেহের-উন-নিসা বেগম বা ঘসেটি বেগমের বিয়ে হয়েছিল নওয়াজিস মুহাম্ম’দ শাহমাত জং এর সঙ্গে, যিনি ঢাকার নায়েবে নাজিম নিযুক্ত হয়েছিলেন। ঘসেটি বেগম দেখতে কেমন ছিলেন তার সচিত্র উল্লেখ তেমন নেই।

মুনতাসীর মামুনের বই
শ্রী পারাবাতের লেখা ‘আমি সিরাজের বেগম’ বইয়ে সিরাজেউদ্দৌলার স্ত্রী লুৎফার বয়ানে রচিত গদ্যে ঘসেটি বেগমকে ‘সুন্দরী’, ‘আভিজাত্যপূর্ণ’, ‘চতুর’, ‘বদমেজাজি’ এবং ‘উচ্চাভিলাষী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

নবাব আলীবর্দী খানের প্রাসাদ হীরাঝিলের একমাত্র শক্তিশালী নারী চরিত্র এই ঘসেটি বেগম, যাকে বাইরের পৃথিবী চিনতে পেরেছে।

তিনি এতটাই প্রভাবশালী ছিলেন যে মুর্শিদাবাদে নবাব আলীবর্দী খানের তিন মেয়ের মধ্যে একমাত্র তারই আলাদা একটি প্রাসাদ ছিল।

হীরাঝিল প্রাসাদের মতই জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদের নামও ছিল নবাবের বাড়ির নামের সঙ্গে মিলিয়ে, মতিঝিল।

বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায়, ঘসেটি বেগমের ‘রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা’ ছিল এবং তিনি প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন।

তিনি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ছিলেন।

ঘসেটি যে কারণে ষ’ড়যন্ত্রে অংশ নেন

নবাব আলীবর্দী খানের কোন ছেলে ছিল না।

তিনি ছোট মেয়ে আমিনা বেগমের বড় ছেলে সিরাজউদ্দৌলাকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করেছিলেন।

এতে ঘসেটি বেগম অসন্তুষ্ট ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন তার পালকপুত্র, সিরাজউদ্দৌলার আপন ভাই ইকরামউদ্দৌলাকে ওই স্থানে দেখতে।

কিন্তু ইকরামউদ্দৌলা অল্প বয়সে গুটিবসন্তে মা’রা যান।

এরপর তিনি তার মেজ বোনের ছেলে শওকত জংকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন।

কিন্তু নবাব আলীবর্দী খান সেটিও পছন্দ করেননি।

এসব কারণে ঘসেটি বেগম সিরাজউদ্দৌলাকে পছন্দ করতেন না, সিরাজউদ্দৌলাও তাকে পছন্দ করতেন না।

পিতার উত্তরাধিকারী নির্বাচনে তার মতামত গুরুত্ব পায়নি ঠিকই, কিন্তু বড় মেয়ে হিসেবে নবাব আলীবর্দী খানের কাছে তিনি গুরুত্ব পেতেন এবং রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতেন।

তার সুপারিশে কেউ পদ হারিয়েছে, আবার কেউ ক্ষমতার কেন্দ্রে এসেছেন।

বাংলাপিডিয়া বলছে, নিজের প্রভাব কাজে লাগিয়ে তিনি বিপুল বিত্তের মালিক হয়েছিলেন।

এছাড়া ১৭৫৫ সালে স্বামীর মৃ’ত্যুর পরেও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রচুর অর্থের মালিক হয়েছিলেন তিনি।

তার স্বামী নওয়াজিস মুহাম্ম’দ শাহমাত জং ঢাকার নায়েবে নাজিম ছিলেন, কিন্তু মূলত ঢাকা পরিচালনা করতেন ঘসেটি বেগম।

ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন তার ‘ঢাকা স্মৃ’তি বিস্মৃ’তির নগরী’ বইয়ে লিখেছেন, “ঢাকার শাসনভার প্রকৃতপক্ষে ছিল ঘসেটি বেগম ও তাঁর বিশ্বস্ত দেওয়ান, অনেকের মতে প্রণয়ী, হোসেন কুলি খানের হাতে। কারণ নওয়াজিস ছিলেন দুর্বল প্রকৃতির লোক।”

এদিকে নবাব আলীবর্দী খানের মৃ’ত্যুর পর নবাব হয়ে সিরাজউদ্দৌলা ঘসেটি বেগমকে অন্তরীণ করেছিলেন।

সেসময় সিরাজউদ্দৌলা ঢাকার আয়-ব্যয়ের হিসাব চেয়েছিলেন, কিন্তু রাজভাণ্ডার বা অর্থনৈতিক দায়িত্বে থাকা রাজবল্লভ সঠিক হিসাব দিতে ব্যর্থ হন।

রাজবল্লভ রাজকোষ থেকে প্রচুর অর্থ আত্মস্যাৎ করেছিলেন বলে অ’ভিযোগ রয়েছে।

তার ছেলে কৃষ্ণবল্লভ সিরাজউদ্দৌলার কাছ থেকে বাঁচতে কলকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ফোর্ট উইলিয়ামে আশ্রয় নেন।

কৃষ্ণবল্লভকে ফেরৎ চেয়ে কলকাতায় ইংরেজ গভর্নরের কাছে চিঠি লেখেন সিরাজউদ্দৌলা।

পলা’শীর যু’দ্ধের সেটিও একটি কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কৃষ্ণবল্লভকে ফেরত দিতে রাজি হয়নি।

এদিকে, সিরাজউদ্দৌলার সে’নাপতি মীর জাফর ছিলেন নবাব আলীবর্দী খানের সে’নাপতি।

তরুণ নবাবের সঙ্গে ব্যক্তিত্বের সং’ঘাতের ফলেই একসময় সিরাজউদ্দৌলাকে উৎখাতের ষ’ড়যন্ত্রে নামেন তিনি।

তখন তার সঙ্গে যোগ দেন ঘসেটি বেগম।

ষ’ড়যন্ত্রে আরো যুক্ত হয় ব্যবসায়ী জগৎ শেঠ এবং উমিচাঁদ। সবার অভিন্ন উদ্দেশ্য ছিল নবাবকে উৎখাত করা।

বাংলাপিডিয়া বলছে, সিরাজউদ্দৌলাকে উৎখাতের পরিকল্পনায় ঘসেটি বেগম প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছিলেন।

অবশেষে ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলা’শী প্রান্তরে ইংরেজ বাহিনীর কাছে হেরে যান নবাব সিরাজউদ্দৌলা।

সূত্রঃ বিবিসি