সুন্দরী নায়িকার কা’ন্না দেখে যে আবেগ জাগে, সেটা কি একজন নি’খোঁজ বক্তার মায়ের আকুতির জন্য জাগছে?

| আপডেট :  ১৫ জুন ২০২১, ১০:৪১ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ১৫ জুন ২০২১, ১০:৩৩ পূর্বাহ্ণ

জনপ্রিয় নায়িকা পরীমনি যখন ধ”ণচে’ষ্টা ও হ’’ত্যা’চেষ্টার অ’ভিযোগ নিয়ে থানায় গিয়ে হ’য়রান হচ্ছিলেন, ঠিক তখন রংপুরের এক তরুণ ইসলামি বক্তা তিন সঙ্গীসহ নি”খোঁজ হন। তাঁদের স্বজনেরাও থানায় গিয়ে অ’ভিযোগ দাখিল করতে ব্য’র্থ হন। ওই একই সময়ে মধুপুরের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার এক না’রীকে ব’র্ব’রভাবে ধ”ণ করে তিন ম’দ্য’প। কাছাকাছি সময়ে সাভারে ছুটির দাবিতে আ’ন্দোলন করার সময় পুলিশের ধা’ওয়া খেয়ে পা’লাতে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে মা”রা যান দুই স’ন্তানের জননী জেসমিন। পরীমনির কা’ন্না আমরা দেখেছি, কিন্তু জেসমিনের স’ন্তানদের কা’ন্নার সামনে ক্যামেরা নিয়ে যাবে কে? কে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ওই না’রীকে চি’কিৎসা করাবে, সুবিচার দেবে? তরুণ ইসলামি বক্তা আবু ত্ব-হা মুহাম্ম’দ আদনানের স্ত্রী ও মায়ের কাছে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার কি কোনো কর্তৃপক্ষ আছে?

বোট ক্লাবের ঘটনা নিয়ে ফেসবুক সরগরম হয়ে আছে। সুন্দরী নায়িকার জন্য যে আবেগ ও আবেদন জাগে, সেটা কি একজন শ্র’মিকের জন্য বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার না’রীর জন্য বা নি’খোঁজ বক্তার জন্য জাগছে? ও’পরে বলা সব কটি ঘটনায় নারীরা ভু’ক্তভোগী। তাহলেও সবার য’ন্ত্রণার ওজন মাপার সমান বাটখারা আমাদের নেই। মানুষের আবেগও বাছাই করা, বিচারও বাছাই করা ব্যক্তিরাই পান। আমরা আইন ও প্রশাসনের বৈ’ষম্যের কথা বলি, স’রকারি পক্ষপাতের কথা বলি। অথচ নিজেদের হৃদয়ের আ’দালতে সবার কা’ন্না সমান আ’লোড়ন তোলে না। আমাদের নৈতিকতার মাপকাঠি নারীর জন্য এক রকম, পুরুষের জন্য আরেক রকম। সহানুভূতির বাতাস ধনী ও মধ্যবিত্তের পালে যতটা লাগে, গরিবের ছেঁড়া পালে ততটা লাগে না।

পক্ষপাত যখন আমাদের মনে, তখন তার সুযোগ নেওয়া হবেই। পরীমনির কা’ন্না দিয়ে ঢেকে দেওয়া হবে আদনানের স্ত্রীর কা’ন্নাকে। এ সুযোগ আমরাই দিচ্ছি বলে পুলিশও বাছাই করা বি’ষয়ে তৎপর হবে। একজন মানুষ, তিনি যে ধর্মের হোন, যে চিন্তাভাবনা হোন, মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে না পারার দেশে কিছু মানুষকে কম-মানুষ করে রাখা হয়। সুনামগঞ্জের শাল্লার ঝুমন দাস বিনা বিচারে আ’টক থাকবেন, রংপুরের তরুণ বক্তা আদনানকে খুঁজে বের করার চে’ষ্টা থাকবে না, প্র’ভাবশালীরা দ্রুত জা’মিন পাবেন, মোদির সফরের প্র’তিবাদকারী অজস্র তরুণ জে”লের ভেতর আ’ট’কা পড়ে থাকবে।

কথায় কথায় আমরা স’রকারকে দো’ষ দিই। কিন্তু আমরা যেমন, তেমন স’রকারই আমরা পাই। যে দেশে গণ’পি”টুনির সামাজিক বৈ’ধতা থাকে, সেই দেশে ক্র”সফা’য়ারও সামাজিক স’ম্মতি পাবে। যে দেশে না’রীকে একই স’ঙ্গে নি’ষি’দ্ধ ও লো’ভনীয় ভাবাই রেওয়াজ, সেখানে তো যৌ”ন নি’র্যা’তনের ইস্যুকে খাটো করে দেখাই দস্তুর। তখনই দেখা যাবে, পরীমনির অ’ভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবসায়ী নাসির ইউ মাহমুদ আ’টক হলেও মুনিয়া হ’”ত্যার প্রতিকার হবে না। বি’ষয়টি ধা’মাচা’পা পড়ে যাবে এবং অ’ভিযুক্ত আ’সামি স্বমহিমায় খেলার মাঠে বহাল থাকবেন। নি’হ’ত মেয়েটি ঠাঁই পাবে তনুর মতো বি’চারহীন হ’০’ত্যার শি’কারদের খাতায়। কিছু হ’০’ত্যা তাই ত’দন্তের তলায় চা’পা পড়বে, কিছু ঘা’ত’ক উঠে যাবে আইনের ঊর্ধ্বে।

আবেগকেও তাই প্রশিক্ষিত করতে হয়। তা যেন একচক্ষু হরিণের মতো এক দিকেই না ছোটে। ফেসবুকে যাঁরা পরীমনির পক্ষে, তাঁরা বিপক্ষের যু’ক্তিবা’দীদের সম্ভাব্য ধ’০র্ষ’ক বলছেন। আবার ব্যবসায়ী নাসিরকে যাঁরা ষ’ড়য’ন্ত্রের শি’কার বলে ভাবছেন, যাঁরা তাঁর ব্যাপারে সহানুভূতিশীল, তাঁরা পরীমনির পক্ষের মানুষদের অ’নৈতিকতার পূজারি গণ্য করবেন কেন? আ’দালতে দুই পক্ষের উকিলরা যখন সওয়াল-জবাব করেন, তখন কি তাঁরা একে অন্যকে শ”ত্রু ভাবেন? ভাবেন না।

সমাজ কথাটার মধ্যে ‘সম’-এর ধারণা আছে। সব অন্যায়কে সমান চোখে দেখা, সব মানুষের মর্যাদা ও অধিকার সমান বলে ভাবাই সভ্যতা। আমরা পশ্চিমা সমাজের যতই দো’ষ ধ’রি না কেন, সেখানে মানুষে মানুষে আইনগত সমতা অন্তত অ’স্বীকার করা হয় না। সেসব রাষ্ট্রের আইন আগে সমতা আনেনি, মা’নুষের আ’ন্দোলন ও চেতনা আগে এসেছে, তারপর রাষ্ট্র সেই চে’তনাকে আইনের মাধ্যমে স্বীকৃতি দিয়ে বাস্তবায়নে নেমেছে। বাংলাদেশের আইন ও রাষ্ট্রকে মানবিক সাম্যের দিকে নিতে হলে সামাজিক ফ্যাসাদ আগে দূর করা লাগবে।

সমাজের অনাচার ও ভেদ-বৈষম্যের প্রতিবিম্বই আমাদের স’রকার ও রাষ্ট্রে দেখা যায়। রাজনীতি এই ভেদের বাজার চাঙা রাখে। তাতে দ’ম’নকারী ক্ষমতার মস্ত সুবিধা হয়। এই যেমন মুক্তিযো’দ্ধাদের মৃ’ত্যুর পর রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানোর গার্ড অব অনারে না’রী ইউএনও রাখার বি’রু’দ্ধে বলেছে সং’সদীয় কমিটি। এর আগে জে’লা প্রশাসনের সর্বোচ্চ দুটি পদে একই সঙ্গে দুই নারী যাতে পদায়িত না হন, তার দা’বি এসেছে। দেখা যাবে, সমাজে এ ধরনের বৈ’ষম্যের পক্ষে জো’রদার সমর্থন আছে।

পরীমনি না’রী বলে বাড়তি সুবিধা না পান, আবার না’রী বলে কমও যেন না পান। পোশাকশ্র’মিক জেসমিন কিংবা ধ”ণে’র শি’কার ক্ষুদ্র জাতিসত্তার না’রীর জন্যও যাতে আইন দাঁড়ায়। নি’খোঁজ বক্তা আদনান যেন ‘ই’সলামি’ বলে প্রশাসনিক অবজ্ঞার শি’কার না হন। আমরা জানি, রাতারাতি পরিস্থিতি বদলাবে না, কিন্তু নিষ্ঠা নিয়ে পরিবর্তনের কাজ করে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর উপায় কী? সেটাই বাঁচার পথ।

ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]
সূত্রঃ প্রথম আলো