হাসপাতালে আয়েশি জীবন কাটাচ্ছে ভিআইপি বন্দিরা

| আপডেট :  ১৫ জুন ২০২১, ০৭:২০ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ১৫ জুন ২০২১, ০৬:৫৪ পূর্বাহ্ণ

নানা রো’গের ছুতোয় হাসপাতালে আয়েশি জীবন কা’টাচ্ছেন ‘ভিআইপি ব’ন্দিরা’। খু’ন, অ’স্ত্র, মা’দক ও অর্থ আ’ত্মসাৎ মা’মলার আ’সামি হয়েও ঘুরেফিরে তারা পছন্দের হাসপাতালেই থাকছেন। এদের একজন প্রথম দফায় টানা ৮ মাস এবং বর্তমানে সাত মাস ধরে হাসপাতালেই আছেন। অপর এক ব’ন্দি হাসপাতালে ছিলেন টানা ১৬ মাস।

তাকে কা’রাগারে ফেরাতে ২৭ বার চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কাজ হয়নি। আরও অনেকেই আছেন যারা মাসের পর মাস বিভিন্ন হাসপাতালে আছেন। কা’রাগার ও হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি চ’ক্র মোটা টাকার বিনিময়ে অ’সুস্থতার অজুহাতে তাদের হাসপাতালে থাকার সুযোগ করে দিচ্ছেন বলে অ’ভিযোগ আছে। অথচ গ্রে’ফতারের আগে এসব আ’সামি সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে চষে বেড়িয়েছেন দেশ-বিদেশ।

অ’ভিযোগ আছে, এরা প্রভাব খাটিয়ে হাসপাতাল কেবিনেই গড়েছেন ‘স্থায়ী নিবাস’। সেখান থেকেই চা’লিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসা-বাণিজ্য। মুক্তজীবনে ফিরতে নানা মহলে তদবিরও করছেন। অথচ সাময়িক সময়ের চিকিৎসার জন্য তাদের কা’রাগার থেকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। চিকিৎসা শেষে তাদের ফেরত পাঠানোর কথা থাকলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তা করছেন না। ফলে এদের অনেকেই ব’ন্দি জীবনের বেশির ভাগ সময় ঘুরেফিরে হাসপাতালেই কা’টাচ্ছেন। কা’রাগার থেকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে পাঠানো চিঠির সূত্র ধরে অনুসন্ধানে জানা গেছে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য।

জানা গেছে, যুবলীগের ব’হিষ্কৃ’ত নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, বি’তর্কি’ত ঠিকাদার এসএম গোলাম কিবরিয়া ওরফে জি কে শামীম ও ডেসটিনি গ্রুপের কর্ণধার রফিকুল আমীন কা’রাগারে ‘ভিআইপি ব’ন্দি’ হিসেবে পরিচিত। কারণ গ্রে’ফতারের পর থেকেই তারা ঘুরেফিরে কা’রাগারের চেয়ে হাসপাতালেই বেশি সময় থাকছেন। মাঝে মধ্যে ক’ঠোর সমালোচনার মুখে তাদের কা’রাগারে ফেরত পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানেও থাকেন কারা হাসপাতালে। তাদের কখনোই কা’রাগারের সাধারণ সেলে থাকতে হয়নি। এ কারণেই এদের গায়ে লেগেছে ভিআইপি তকমা। এমন আরও অনেক প্রভাবশালী ব’ন্দি আছেন যারা কারাবাস নয়, হাসপাতাল বাসে পার করছেন সাজার মেয়াদ।

এ ব্যাপারে ঢাকা কেন্দ্রীয় কা’রাগারের জে’লার মাহবুবুল ইসলাম বলেন, সম্রাটের শা’রীরিক অবস্থা খুব বেশি ভালো নয়। তার কার্ডিয়াক স’মস্যা আরও জটিল হয়েছে। তাই তিনি হাসপাতালে আছেন। জি কে শামীমকে পাঠানোর পর ক’রোনা ধরা পড়ে। আর রফিকুল আমীনের ডায়াবেটিস খুব বেশি ওঠানামা করছে তাই তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, এদের নিরাপত্তা দিতে দৈনিক নিয়োগ করা হয় ২০০ কারারক্ষী। এতে কারা কর্তৃপক্ষকে হিমশিম খেতে হয়।

তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বি’ষয়ে জানতে চাইলে কারা অধিদপ্তরের ঢাকা ডিভিশনের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন) তৌহিদুর রহমান বলেন, ‘অ’সুস্থ হলে চিকিৎসকের পরামর্শে কারা কর্তৃপক্ষ ব’ন্দিদের হাসপাতালে পাঠায়। কিন্তু ছাড়পত্র দিয়ে ফেরত পাঠানোর দায়িত্ব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। কারা কর্তৃপক্ষ প্রতি ১৫ দিন পর আ’সামিদের ফেরত পাঠানোর তাগাদা দিয়ে চিঠি পাঠাচ্ছে।’

কারা কর্তৃপক্ষের অ’ভিযোগের বি’ষয়ে জানতে চাইলে বিএসএমএমইউর উপা’চার্য শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কা’রাগারের অধীনে আমাদের এখানে একটি ইউনিট চলে। অ’সুস্থ হাজতি ও কয়েদিদের কারা কর্তৃপক্ষের ইচ্ছা অনুযায়ীই এখানে ভর্তি করা হয়। সুস্থ কাউকে এখানে থাকতে দেওয়ার কোনো এখতিয়ার আমাদের নেই। কেউ সুস্থ হয়ে থাকলে কারা কর্তৃপক্ষ যে কোনো সময় তাকে নিয়ে যেতে পারে। চিকিৎসা ছাড়া বা অ’সুস্থ নয় এমন কেউ থাকলে পরিচালককে বলব তাদের দ্রুত ফেরত পাঠাতে।

সংশ্লিষ্ট নথিপত্রে দেখা গেছে, ক্যা’সিনোবি’রোধী অ’ভিযানকালে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর গ্রে’ফতারের পর মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতির পদ থেকে ব’হিষ্কৃ’ত হন ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট। তার বি’রুদ্ধে মা’দক, অ’স্ত্র আইন ও অ’বৈধ সম্পদ অর্জনের অ’ভিযোগে মা’মলা হয়। গ্রে’ফতারের পর তিনি কিছুদিন কারা হাসপাতালে ছিলেন। মাসখানেকের মধ্যেই ওই বছরের ২৪ নভেম্বর তিনি ‘বুকে ব্য’থা’ নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে ভর্তি হন। সে দফায় তিনি হাসপাতালে ছিলেন টানা ৮ মাস।

ভর্তির পর গত বছরের জুলাই পর্যন্ত তাকে ফেরত পেতে কা’রাগার থেকে বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষকে ১১টি চিঠি দেওয়া হয়েছিল। এ নিয়ে তখন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে ব্যাপক সমালোচনার মুখে তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কা’রাগারে ফেরত পাঠানো হয়। সেখানে গিয়েও তিনি কারা হাসপাতালেই থাকেন।

সবশেষ ফের তিনি বিএসএমইউতে ভর্তি হন গত বছরের ২৪ নভেম্বর। এখন পর্যন্ত তিনি আছেন প্রিজন এনেক্স ভবনের কেবিনে। তাকে কা’রাগারে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে এ পর্যন্ত ১০টি চিঠি পাঠানো হয়েছে। সবশেষ চিঠি দেওয়া হয় গত ১ জুন। কিন্তু তাকে ফেরত পাঠাচ্ছে না বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ।

তবে কা’রাগারের এক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, সম্রাটের শা’রীরিক অবস্থা আসলেই ভালো নয়। নানা ধরনের জটিলতায় ভুগছেন তিনি। তার উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। একইভাবে গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর গ্রে’ফতারের পর ঘুরেফিরে হাসপাতালের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিনে আয়েশি সময় কা’টাচ্ছেন বি’তর্কি’ত ঠিকাদার এস এম গোলাম কিবরিয়া ওরফে জি কে শামীম। শেষ দফায় তিনি গত ১৫ এপ্রিল বিএসএমএমইউতে ভর্তি হন।

‘বুকে ব্য’থা’ অনুভব করলে অ’স্ত্র ও মা’দক মা’মলার এই আ’সামিকে কা’রাগার থেকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। চিকিৎসা শেষে দুই দিনের মধ্যে তাকে কা’রাগারে পাঠানোর কথা। কিন্তু এখনো তাকে ফেরত পাঠানো হয়নি। এ কারণে মে মাসে দুটি ও সবশেষ ১ জুন একটি চিঠি দেওয়া হয়। অ’ভিযোগ আছে, মোটা টাকা খরচ করে অ’সুস্থতার ছুতায় হাসপাতালের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিনে থাকেন জি কে শামীম।

পরিচিতজনদের সঙ্গে নিয়মিত দেখাসাক্ষাৎ করেন। সেখানে বসেই তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য চালাচ্ছেন। জা’মিনের জন্য তদবিরও করছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে এখনো কোনো মহল থেকেই সবুজ সংকেত পাননি বলে তার ঘনিষ্ঠ সূত্র নিশ্চিত করেছে। আগের দফায় গত বছরের ৪ এপ্রিল হাসপাতালে ভর্তি হলে ৭ বার চিঠি চালাচালির পর কা’রাগারে ফেরত পাঠানো হলেও কয়েদিদের সেলে থাকেননি তিনি। থেকেছেন কারা হাসপাতালে।

হাসপাতালে থাকার ক্ষেত্রে সম্রাট-শামীমকেও পেছনে ফে’লেছেন ডেসটিনি গ্রুপের কর্ণধার রফিকুল আমীন। নানা বাহা’নায় তিনি টানা এক বছরের বেশি সময়ও হাসপাতালে আয়েশি সময় কাটিয়েছেন। শেষ দফায় গত ১১ এপ্রিল তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। তাকে ফেরত দিতে এরই মধ্যে তিন দফা চিঠি দেওয়া হয়েছে। কারা নথিতে দেখা গেছে, ২০১২ সালে গ্রে’ফতার হওয়ার পর রো’গী হিসেবে বেশির ভাগ সময় রফিকুল আমীন বার’ডেম ও বিএসএমএমইউ হাসপাতালে থেকেছেন।

তিনি সর্বোচ্চ টানা ১ বছর ৪ মাস হাসপাতালে থেকেছেন। তখন তাকে ফেরত নিতে ২৭ বার চিঠি পাঠানোর বি’ষয়টি ফাঁ’স হলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ওই সময় তাকে কা’রাগারে ফেরত পাঠাতে বা’ধ্য হয়েছিল বিএসএমএমইউ। কিন্তু বেশিদিন কারাভ্যন্তরে থাকেননি তিনি। আবার ফিরেছেন বিএসএমএমইউতে। তবে তিনি অ’সুস্থ বলে দাবি করেছেন তার স্বজন ও কা’রাগারের চিকিৎসকরা।

এদিকে অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষিকা জয়ন্তী রেজা হ’’ত্যা মা’মলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আ’সামি আজম রেজাসহ ২০ থেকে ৩০ জন ব’ন্দি সুযোগ পেলেই নানা ছুতোয় সব সময়ই বিভিন্ন হাসপাতালে কা’টান বলে কারা নথিতেই তথ্য রয়েছে।

আইনবিদ ড. শাহদীন মালিক বলেন, এই বেআইনি সুযোগ-সুবিধা থেকে স্পষ্ট, এরা অ’পরাধ জগতের ক্ষমতাধর ব্যক্তি। এদের প্রচুর অর্থবিত্ত আছে। কাদের সুপারিশে দীর্ঘ সময় ধরে তারা হাসপাতালে থাকছেন, তা-ও দেখা উচিত। যারা কা’রাগারে যাচ্ছেন বা আছেন, তাদের চিকিৎসাসেবা পেতে অনেক ক্ষেত্রে আ’দালতের আদেশ লাগছে। এসব বন্ধে কা’রাগারের অভ্যন্তরীণ দু’র্নীতির অনুসন্ধান করা উচিত। সূত্রঃ যুগান্তর