বাংলাদেশকে ভ্যাকসিন দেবে না ভারত, এ কেমন বন্ধুত্ব?

| আপডেট :  ৯ জুন ২০২১, ০৬:৫৯ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ৯ জুন ২০২১, ০৬:৫৯ পূর্বাহ্ণ

করোনা
পেন্ডেমিকে বিপর্যস্ত বিশ্ব করোনার ভ্যাকসিনকেই ঘুড়ে দাঁড়ানোর প্রথম অস্ত্র হিসেবে নির্ধারণ করেছিল। সেই থেকেই বিশ্বব্যাপী শুরু হয়েছিল ভ্যাকসিন ডিপ্লোম্যাসি। সাম্প্রতিক কয়েক বছর ধরে চীন-ভারতের সীমান্ত সংঘাত ও ভূ-রাজনীতিতে অনেকটা কোনঠাসা ভারত ভ্যাকসিন রাজনীতিতে যেন ঘুড়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। হঠাৎই নরেন্দ মোদীর কণ্ঠ যেন উঁচুতে উঠে গেলো। এর পেছনের কারণটি ছিল ভারতের বেসরকারী ভ্যাকসিন উৎপাদক প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউট। ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে মহারাষ্ট্রের ব্যবসায়ী সাইরাস পুনেওয়ালার মালিকানাধীন রিয়েল এস্টেট কোম্পানী পুনাওয়ালা হোল্ডিং অ্যান্ড

ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানীর সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়। শতকোটি দরিদ্র মানুষের দেশ ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ায় নানাবিধ সংক্রামক ব্যাধির টিকা সরবরাহের টার্গেট নিয়ে এটি ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবির্ভূত হয়। সেরাম ইনস্টিটিউটের আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও গ্রহণযোগ্যতার পেছনে টিকা প্রস্তুত ও সরবরাহের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এর কমিটমেন্ট বড় ভূমিকা পালন করেছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, প্যান আমেরিকান হেল্থ অর্গানাইজেশনসহ বিশ্ব সংস্থার আন্তর্জাতিক তহবিল দ্বারা পরিচালিত বিভিন্ন ইমিউনাইজেশন প্রোগ্রামের টিকা তৈরী ও সরবরাহ করে সেরাম ইনস্টিটিউট দীর্ঘ ৫ দশকে এই অবস্থান গড়ে তুলেছে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ও ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানীর সহযোগিতা ও যৌথ কার্যক্রমের সুবিধা পেয়ে এসেছে সেরাম ইনস্টিটিউট। এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকদের সাথে বৃটিশ-সুইডিশ বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানী এস্ট্রাজেনেকার যৌথ প্রযোজনায় উদ্ভাবিত কোভিড-১৯ এর প্রথম সারির সফল টিকা কোভিশিল্ড

অনুমোদন লাভের পর বিশ্বব্যাপী এর চাহিদা পূরণের কথা বিবেচনায় রেখে ভারতের বৃহত্তম টিকা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউটকে কোভিশিল্ড উৎপাদনের লাইসেন্স দেয়া হয়। ভারতসহ দরিদ্র দেশগুলোকে স্বল্পমূল্যে টিকার চাহিদা পুরণ ও সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই সেরাম ইনস্টিটিউটের সাথে চুক্তি করেছিল এস্ট্রাজেনেকা এবং এর নিয়ন্ত্রক সংস্থা। চুক্তির শর্ত অনুসারে প্রতিডোজ টিকার মূল্য সর্বোচ্চ ৩ মার্কিন ডলার নির্ধারণ করে ২০২১ সাল নাগাদ ভারতসহ অন্যান্য স্বল্প ও মধ্য আয়ের দেশে ১০০ কোটি টিকা সরবরাহের টার্গেট দেয়া হয়। সেরাম ইনস্টিটিউটের টিকা ভারতের নিজস্ব সম্পত্তি নয়। ভারতসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর চাহিদা পূরণে এটি একটি আন্তর্জাতিক ইনিশিয়েটিভ। এই আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সদিচ্ছাকে পাশ কাটিয়ে নরেন্দ্র মোদীর সরকার সেরাম ইনস্টিটিউটের টিকা নিয়ে অপরাজনীতি, কূটকৌশল এবং ভ্যাকসিন ডিপ্লোম্যাসির ফায়দা তুলতে গিয়ে কোটি কোটি মানুষকে বিপদগ্রস্ত করে তুলেছে। নরেন্দ্র মোদির আত্মম্ভরিতা ও উন্নাসিকতায় ভ্যাকসিন জটিলতার শিকার হয়ে বিশ্বের ৯২টি দেশের মানুষ করোনা ভ্যাকসিনের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ায় সবার আগে সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাকের টিকা সাফল্যের স্বীকৃতি লাভ করে। অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার/বাইওএনটেক, রাশিয়ার গ্যামালিয়া ইনস্টিটিউট, মর্ডানা ও জনসন এন্ড জনসনের টিকা প্রায় একই সময়ে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এবং উৎপাদনের ঘোষণা দিয়েছিল। বলাবাহুল্য, এখন পর্যন্ত এসব টিকাই বিশ্বের চাহিদা পূরণে ভূমিকা পালন করে চলেছে। এসব টিকা নিয়ে রাজনীতি ও বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা না করতে জাতিসংঘ ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তরফ থেকে আগেই আহ্বান জানানো হয়েছিল। সব দেশের ধনী-গরীব সব মানুষ যেন একই সময়ে করোনার টিকা নিয়ে একই সময়ে বিশ্বকে ঝুঁকিমুক্ত করতে পারে, এটাই ছিল করোনা ভাইরাসের টিকা বিতরণে আন্তজার্তিক সংস্থাগুলোর তাগিদ। তবে কোনো রেগুলেটরি সিস্টেম না থাকায় সেসব তাগিদ ও আহ্বানে খুব বেশি কাজ হয়নি। ইতিমধ্যে ধনী-গরীব দেশগুলোর মধ্যে ব্যাপক ব্যাবধান সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। ধনী দেশগুলো করোনা ভ্যাকসিনের ব্যাপক মজুদ গড়ে তোলায় গরবি দেশগুলো ভ্যাকসিন পাচ্ছে না। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

তাদের মজুদকৃত ভ্যাকসিন থেকে বিভিন্ন দেশকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে ভ্যাকসিন কূটনীতি শুরু করেছে। আমেরিকার সাথে ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত সম্পর্কের খাতিরে আমেরিকার মজুদ থেকে দরিদ্র দেশগুলোতে সম্ভাব্য ৮ কোটি ডোজ টিকা বিতরণে বড় একটি অংশের ভাগ বসাতে চায় ভারত। সেরাম ইনস্টিটিউটের টিকা নিয়ে নরেন্দ্র মোদির সরকার অনেক অপরাজনীতি, ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ ও বাগাড়ম্বর করলেও তাদের নিজেদেরও শেষ রক্ষা হয়নি। সেই সাথে তারা বিশ্বের শতকোটি মানুষকে ভ্যাকসিনের অনিশ্চয়তার মধ্যে নিক্ষেপ করেছে। বাস্তবতা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ নরেন্দ্র মোদী যেন সেরাম ইনস্টিটিউটের ভ্যাকসিন দিয়ে বিশ্বজয় করে ফেলতে চলেছেন! শতকোটি ভারতীয়কে টিকার আওতায় আনতে তারা আর কোনো বিকল্প উৎসের দিকে না তাকিয়ে একদিকে নিজ দেশের মানুষকে চরম ঝুঁকিতে ফেলেছে, অন্যদিকে অসময়ে টিকা রফতানি বন্ধের ঘোষণা দিয়ে সেরাম ইনস্টিটিউটের টিকার উপর নির্ভরশীল দেশগুলোকেও চরম ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভারতের অবস্থা সব দেশের সব পর্যায়কে অতিক্রম করেছে। সরকারি হিসেবেই প্রতিদিন তিন-চার লাখ নতুন সংক্রমণ এবং তিন-হাজার মানুষের মৃত্যুর তথ্যের বাইরে প্রকৃত অবস্থা অরো অনেক ভয়াবহ। ভারত সরকার সেখানকার করোনা পেন্ডেমিকের প্রকৃত অবস্থা তথা সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা গোপণ করছে বলে বিভিন্নভাবে অভিযোগ উঠেছে।

বাংলাদেশ যখন চীনা সিনোফার্মের টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে যেতে সম্মত হয়েছিল, ঠিক তখনি ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা দিল্লী থেকে উড়ে এসে বাংলাদেশের সাথে ভারতের বন্ধুত্বের অনন্য উচ্চতার পরিমাপের ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, ভারত ও বাংলাদেশে একই সময়ে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হবে, ভারত বাংলাদেশের চাহিদা পূরণ করবে। যে কথাটি প্রকশ্যে আসেনি তা হচ্ছে, চীন বা অন্য কোনো দেশের সাথে টিকা কেনার চুক্তি করার দরকার নেই। এ কারণেই থেমে গিয়েছিল চীনের সাথে টিকা চুক্তির প্রক্রিয়া। সেরাম ইনস্টিটিউটের সাথে টিকা চুক্তির পর ৬০০ কোটি টাকা সেরাম ইনস্টিটিউটের ফান্ডে জমা হওয়ার পর টিকা রফতানি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলে বাংলাদেশে হইচই পড়ে যায়। ভারতের সাথে বন্ধুত্বের মিথ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়লে দিল্লীর তরফ থেকে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল, নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের সাথে চুক্তিকে অ্যাফেক্ট করবে না। কিছুটা দেরি হলেও বাংলাদেশ টিকা পাবে। এ কথা নিশ্চিত যে, এক সময় বিশ্বের সব মানুষই করোনার টিকা পাবে। চলতি বছরের মধ্যেই হয়তো পশ্চিমা বিশ্ব ও ধনী দেশগুলো নিজেদের চাহিদার অধিকাংশ পূরণ করে ফেলতে পারবে। এরপর চীন-রাশিয়া-সেরাম ইনস্টিটিউটসহ টিকা উৎপাদক কোম্পানীগুলোর সক্ষমতা নিবদ্ধ হবে বঞ্চিত দরিদ্র দেশগুলোর উপর। ততদিনে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা ও সক্ষমতায় বেশকিছু দেশ তাদের সম্ভাবনার দুয়ার থেকে ছিটকে পড়বে। ভারত

সম্ভবত বাংলাদেশকে সেই সারিতেই দেখতে চায়। ভারতের নানামুখী শোষণ ও ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও গত তিন দশকে সামাজিক-অর্থনৈতিক নানা সূচকে বাংলাদেশ ভারতকে টপকে যেতে সক্ষম হয়েছে। বিজেপির ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতের কাছে এটা হয়তো সমর্থনযোগ্য নয়। বাংলাদেশসহ প্রতিবেশীদের সবদিক থেকে দাবিয়ে রাখাই হচ্ছে তাদের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সেখানে দ্বিচারিতার বৈশিষ্ট্যও বিদ্যমান। ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ উপনিষদের এই বাগধারার অর্থ হচ্ছে, পুরো বিশ্বই একই পরিবার। ভারতের ভ্যাকসিন কূটনীতির শুরুতে নরেন্দ্র মোদি এই বাগধারা ব্যবহার করেছিলেন। সেই সাথে এটাও স্মরণে রাখা জরুরী যে, সেরাম ইনস্টিটিউটের কোভিশিল্ড কোনো একক সম্পদ নয়। অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকার কাছ থেকে লাইসেন্স পাওয়ার মূল শর্তই ছিল দরিদ্র দেশগুলোকে স্বল্পমূল্যে টিকা সরবরাহ করা। সেখানে বড় ধরণের ধরা খাওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খয়রাতি টিকায় ভাগ বসাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উড়ে গিয়ে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর হুভার ইনস্টিটিউটে দেয়া বক্তৃতায় বলেছেন, দেশগুলোকে অবশ্যই বিশ্বস্বার্থের জন্য তাদের জাতীয় স্বার্থের বাইরে তাকাতে হবে।’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জয়শঙ্করের এই বক্তৃতার এক সপ্তাহ পরে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী জানিয়েছেন, ‘বাংলাদেশকে টিকা দেবে না ভারত’। বাংলাদেশ তো ভারতের টিকা ভিক্ষা চায়নি, ভারতই নিজের আধিপত্য কায়েম রাখতে ভ্যাকসিন কুটনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে চীনা টিকা প্রাপ্তি থেকে বিরত রাখতে চেয়েছিল। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও মান বজায় রেখেই সেরাম ইনস্টিউট টিকা বিক্রির চুক্তি করে আগাম অর্থ গ্রহণ করেছিল। এখন ভারত সরকারের মন্ত্রী-আমলারা বলছে, বাংলাদেশকে টিকা দেয়ার প্রশ্নই ওঠেনা! বাংলাদেশের সাথে বন্ধুেত্বর অনন্য উচ্চতা, ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’র কচকচানি এখন কোথায় গেল?

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের টিকার উপর ভরসা করে বছরের প্রথম দিকেই করোনা ভ্যাকসিন কার্যক্রম শুরু করেছিল বাংলাদেশ। এস্ট্রাজেনেকার দুই ডোজের টিকার একটি গ্রহণ করে দ্বিতীয় ডোজ পাচ্ছে না প্রায় ১৫ লাখ মানুষ। অথচ চুক্তি অনুসারে, ৬ মাসে ৩ কোটি ডোজ টিকা বাংলাদেশে সরবরাহের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বাংলাদেশে সেরামের টিকা নিষেধাজ্ঞা বেআইনী ও অনৈতিক। এ কারণে বাংলাদেশ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং হচ্ছে। এরপরও বাংলাদেশের এক শ্রেণীর রাজনীতিক ভারতের সাথে বন্ধুত্বে কোনো প্রভাব পড়বে না বলে মত দিয়েছেন। দেশের কোটি কোটি মানুষকে ইচ্ছাকৃতভাবে বিপদে ফেলে, দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বড় ধরণের ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার পরও যারা ভারতের প্রেমে হাবুডুবু খায় তাদের বন্ধুত্ব ও সম্পর্কের মানদণ্ড কি তা সাধারণ মানুষের কাছে পরিষ্কার নয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের অর্থায়নে পরিচালিত ইমিউনাইজেশন প্রোগ্রামের বেশির ভাগ অর্থই ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট পায়, এ কারণে এই সংস্থার টিকার উপর ভারত সরকারের অনৈতিক মনোপলি চলতে পারেনা। কোভিড ভ্যাকসিন উৎপাদক কোনো দেশ বা প্রতিষ্ঠান ভ্যাকসিনকে নিজ দেশের একচ্ছত্র সম্পদ বলে গণ্য করে চুক্তির এমন লঙ্ঘন করেছে কিনা আমাদের জানা নেই। ভারত সরকারের অপরাজনীতি ও স্বাস্থ্যখাতের হ-য-ব-র-ল অবস্থার খেসারত বাংলাদেশের মত প্রতিবেশিরা কেন দিবে? বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ককে ভারত মূল্য দেয় বলে তাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে বলা হয়েছে। বিপদে বন্ধুর পরিচয়, বৈশ্বিক করোনাভাইরাস অতিমারীতে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সক্ষমতার উপর ভর করে ভ্যাকসিন উৎপাদন ও বিতরণে বিশ্ব সংস্থাগুলো যখন এই ইনস্টিটিউটের উপর আস্থা রেখে তাদের বাজেট বরাদ্দ ব্যয় করছে, তখন ভারতের সরকার ও রাজনীতিবিদরা ভ্যাকসিনকে জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির হাতিয়ারে পরিনত করতে গিয়ে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চলেছে। তারা নিজদেশে কোভিড সংক্রমণ রোধ করতে পারছে না, সেখানে করোনার প্রাণঘাতী মারাত্মক ভ্যারিয়েন্টে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। কছেশ মাস ধরে প্রতিদিন লাখ লাখ ভারতীয় নতুন ভ্যারিয়েন্টের ভাইরাসের সাথে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস, ইয়েলো ফাঙ্গাসের মত নতুন সংক্রামকের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এসব সংক্রমণ ভারতের ভৌগলিক সীমা ছাড়িয়ে বিশ্বের বহুদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতেও ভারতীয় করোনা ভ্যারিয়েন্টের ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ ধরা পড়ছে। অবস্থা এমন দাঁিড়য়েছে যে, ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। চুক্তি করেও করোনা টিকা রফতানী বন্ধ করে, করোনা চিকিৎসায় অক্সিজেনের ঘাটতির সময় অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ রেখে, সীমান্ত খোলা রেখে ভারতীয় করোনা ভ্যারিয়েন্ট বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেয়ার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে এটাই প্রতিয়মান হয় যে, করোনাকালে ভারত বাংলাদেশের সাথে বন্ধুত্বের বদলে বৈরী আচরণের নজির স্থাপন করেছে।

করোনাভারাইসের শুরুতেই এ নিয়ে নানামাত্রিক কনস্পিরেসি থিউরি ডালপালা বিস্তার করেছে। চীন-আমেরিকার বৈশ্বিক দ্বন্দ্ব ভাইরাসকে ঘিরে নতুন মাত্রা লাভ করেছে। এতে কেউ কাউকে খুব বেশি ঘায়েল করতে না পারলেও ভ্যাকসিন পেতে ভারতের প্রতিশ্রুতির উপর আস্থা রেখে সম্ভবত বাংলাদেশই বিশ্বে সবচেয়ে বড় প্রতারণার শিকার হয়েছে। ভারতের অনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন কার্যক্রমে পিছিয়ে পড়া বাংলাদেশ যখন চীন-রাশিয়াসহ বিকল্প উৎসগুলো থেকে তড়িঘড়ি ভ্যাকসিন সংগ্রহের চুক্তি করেছে তখন সেই চুক্তি ভন্ডুল করতেও আমলাতান্ত্রিক ষড়যন্ত্রের আঁচ পাওয়া যায়। প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে সচিবালয়ে হেনস্তা ও নির্যাতন করে জেলে পাঠানো হয়েছিল। অভিযোগ করা হয়েছে, তিনি করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে চীন-রাশিয়ার সাথে করা গোপণ চুক্তির নথি চুরি করে তা ফাঁস করে দিতে চেয়েছিলেন। এটা যদি করা হতো তাহলে সম্পাদিত চুক্তি বাতিল হয়ে যেতে পারতো। তাদের দাবি অনুসারে, রোজিনা সেই সুযোগ পায়নি। তবে এরই মধ্যে চীনের সাথে করা চুক্তির গোপণ শর্ত ফাঁস করে দিল কারা? জানা যায়, চীন নাকি তথ্য গোপণ রাখার শর্তে অন্যান্য

দেশের চেয়ে কমমূল্যে বাংলাদেশকে টিকা দিতে চেয়েছে। সচিবালয়ের একজন কর্মকর্তা সেই তথ্য প্রকাশ্যে ফাঁস করে দেয়ার পর চীনের টিকা প্রাপ্তিতে নতুন জটিলতা ও অনিশ্চয়তার কথা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। যে আইনে মামলা দিয়ে রোজিনা ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়েছিল সেটি মূলত রাষ্ট্রীয় গোপণীয়তা রক্ষায় বৃটিশদের করা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের জন্য প্রযোজ্য আইন। ঘটনা যদি সত্য হয়, দেশের মানুষকে ভ্যাকসিন থেকে বঞ্চিত রাখার পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র অথবা তৃতীয় কোনো পক্ষের স্বার্থে রাষ্ট্রের গোপণ তথ্য ফাঁস করার অপরাধে কোনো আমলার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। বৈশ্বিক মহামারীতে জাতিকে পিছিয়ে রাখার জন্য, সেই পিছিয়ে পড়া থেকে ঘুরে দাঁড়াতে চীনের সাথে সই করা নতুন চুক্তিকে ভন্ডুল করে দিতে আবার যারা নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছে, তথ্য ফাঁস করে চুক্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পায়তারা করেছে তাদের সম্পর্কে জাতি নীরব-নিস্পৃহ থাকতে পারেনা। সরল অর্থে একে ‘ভুল’ বলে হাল্কা করে দেখার সুযোগ নেই। এ জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে ওএসডি করলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে না। যে অভিযোগে একজন সাংবাদিককে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়েছে, একজন সরকারি কর্মকর্তা সে অপরাধ প্রকাশ্যে করার পর এদেরকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে।
[email protected] সুত্রঃ ইনকিলাব