গরীব ফেরিওয়ালার ছেলে আবুল বাশার হলেন বিসিএস পুলিশ ক্যাডার!

| আপডেট :  ৩ জুন ২০২১, ০৭:০৮ পূর্বাহ্ণ | প্রকাশিত :  ৩ জুন ২০২১, ০৭:০৮ পূর্বাহ্ণ

তিনি গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তে ৩৮তম বিসিএস পুলিশ ক্যাডার থেকে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে পুলিশ হেডকোয়ার্টার, ঢাকায় যোগদান করেছেন । এর আগে তিনি বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে, বাংলাদেশ সচিবালয়, প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন প্রায় দেড় বছর। বলছি আমার মেজো ভাই, জনাব মোঃ আবুল বাশার, সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) সম্পর্কে।

গরীব ফেরিওয়ালা বাবার ৬ সন্তানের মাঝে চার ভাই ও দুই বোন । তিনি ছিলেন মেঝ, ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন মেধাবী। গরীব বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব মোঃ আশ্রাব আলী ফকির । তিনি ছিলেন পরিশ্রমী তার ছিল সততা ও সাহস । এখনও ঝিনাইদহের মানুষ আশ্রাব আলী ফকিরের সততা আর পরিশ্রমের কথা বলে। যাহোক তার একটাই ইচ্ছা ও মনের সুপ্ত বাসনা ছিল। তা হল “আমি ফেরিওয়ালা কিন্তু আমার সন্তান হবে বড় অফিসার”।

এজন্য নিজের আপনজন সবাইকে কোটালীপাড়া রেখে তিনি আমাদের সকলকে নিয়ে ঝিনাইদহের কোরাপাড়া ব্যাকা ব্রীজের কাছে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন সেই ‘৯০ এর পর থেকেই। তিনি তার সকল সন্তানকে পড়ালেখা শিখিয়েছেন। সকলেই শিক্ষিত,আমার আব্বা কোন দিন আমাদেরকে কোন কারণে কড়া শাসন করেননি, কিন্তু পড়ালেখার জন্য শাসন করেছেন। যখন কেউ তাকে কিছু খেতে দিয়েছেন, তিনি না খেয়ে আমাদেরকে ভাগ করে দিয়েছেন আমরাও তার এই আদর্শ নিয়ে চলার চেষ্টা করছি।

জনাব মোঃ আবুল বাসার ছোটকাল থেকে মেধাবী ও শান্ত স্বভাবের ছিলেন কিন্তু জিদ ছিল ভিতরে। শহীদ মশিউর রহমান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঝিনাইদহে পড়াশোনা করতেন। ক্লাস ওয়ান তার রোল ছিল দুই কিন্তু তিনি একদিন প্রথম যার রোল সে না আসাতে খাতা তুলেছিলেন। সে (যার রোল এক) এসে মেঝ ভাইকে বলে খাতা তুলতে হলে রোল এক হওয়া লাগে।

এরপর থেকে প্রতি শ্রেণীতে তিনি ১ম স্থান হতে শুরু করলেন। সেই বিদ্যালয় ছেড়ে তিনি কোরাপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণীতে ভর্তি হন । নতুন স্কুলে ভর্তি হওয়াতে বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারলেন না। সেখানে ৫ম শ্রেণী পাশ করে তিনি ৬ষ্ঠ শ্রেনীতে ভর্তি হন এস,এম, মতলুবুর রহমান মাধ্যমিক হাই স্কুল, ঝিনাইদহে। আবার শুরু হয় ক্লাসে ১ম স্থান অধিকারের যুদ্ধ। টাকার অভাবে তিনি কোনদিন নতুন বই কিনে পড়েতে পারেননি ।

তিনি ভাংরির দোকান থেকে পুরাতন বই নিয়ে এসে পাড়ালেখা করতেন। শিক্ষকদের খুবই আদরের ছিলেন।বিশেষ করে প্রধান শিক্ষক আব্দুস সালাম স্যার। তার কাছ থেকে বেতন নিতেন না এবং আমাদের পরিবারে সকলকে স্কুলে ফ্রী করে দিয়েছেন মেজ ভাইয়ের কারণেই। ২০০৬ সালে এসএসসি – তে জিপিএ ৫.০০ । ২০০৮ সালে শারীরিক অসুস্থতার জন্য এইচএসসি – তে অংশগ্রহণ করতে পারেননি।

এরপর বাবার উৎসাহে মুক্তিযোদ্ধা মশিউর রহমান কলেজ, লাউদিয়া, ঝিনাইদহ থেকে এইচএসসি -তে জিপিএ ৫.০০ পান ২০০৯ সালে। প্রথমবারেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ খ ‘ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় ৪২০তম মেধাস্থান অর্জন করে ইংরেজি বিভাগে পড়াশোনা সুযোগ পান। এরপর বাবার অসুস্থতার কারণে সপরিবারে ২০১০ সালে পৈতৃক ভিটা বর্ষাপাড়া, কোটালীপাড়ায় চলে আসি আমরা। বাড়ি থেকে গরীব বাবার মাত্র ৩ হাজার টাকা নিয়ে তিনি ঢাকা যান এবং ঢাকায় গিয়েই শুরু হয় তার বেঁচে থাকার লড়াই।

আমার কথা বলি আব্বা ঢাকা বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি। আমি দিনে হাসপাতালে, রাতে কবি জসীমউদ্দীন হলে তার খাবার কার্ড দিয়ে খেতাম। রাতে সে টিউশনি করে হাসপাতাল ঘুরে আসত। একদিন রাতে দেখি হলের পাশের দোকানে এক বাটি নুডলস খাচ্ছে । জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাত খাবি না’ । ও বলল একটি কার্ড দিয়ে একজন খেতে পারে। আমি ওই দিন অনেক কষ্ট পেলাম।

কয়েকটা টিউশন করতে লাগলেন এবং গরীব বাবাকে অল্প টাকা পাঠাতে লাগলেন। ছোট ভাই আমি সিরাজ সবধরনের সাহায্য পেতে থাকি। বাড়িতে ছোট ভাই মিরাজ ছিলেন মেধাবী । সে ৮ম শ্রেণীতে JSC – তে জিপিএ ৫.০০ এবং সরকারি টেক্সটাইল ভোকেশনাল ইন্সটিটিউট, কোটালীপাড়া থেকে এসএসসি – তে জিপিএ ৫.০০ পান। এরপর ঢাকা পলিটেকনিক, তেজগাঁওয়ে ভর্তি করেন মেজ ভাই।

চার সেমিস্টার মিলিয়ে মিরাজ ছিলেন ২য়। ছোট ভাইকে ভর্তি এবং হলে তুলতে গিয়ে মেজ ভাই ২০১৩ তে তার স্নাতক শেষ করলেও নিয়মিত ব্যাচের সাথে স্নাতকোত্তর শেষ করতে পারলেন না। কিন্তু ছোট ভাই মিরাজ ২০১৫ সালে একটি দুর্ঘটনায় মারা যায়। সেই শোকে বাবাও ২০১৬ সালে মেজ ভাইয়ের স্নাতকোত্তর পরীক্ষার ফাইনাল বর্ষের শেষ সেমিস্টারের শেষ কোর্স পরীক্ষার আগের দিন মারা যান।

আবারও মেজ ভাই ড্রপ দিতে দিতে বেঁচে যান। কোনো রকমে বাবাকে শেষ দেখা দেখেই তিনি ঢাকায় ফিরে গিয়ে শেষ মুহূর্তে শেষ সেমিস্টারের শেষ কোর্সে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। এরপর অনেকগুলো চাকুরী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেও ব্যর্থ হতে থাকেন। কিন্তু তিনি দমে যাননি । এরপর একসাথে অনেকগুলো চাকুরী পেয়ে যান। এর মধ্যে তিনি ৩৮তম বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে যোগদান করে বাবার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেন।

তিনি চান দেশের মানুষকে ভালবেসে সেবা করতে এবং মাদকমুক্ত দেশ গড়তে। তিনি তার বাবার মত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ ও জনগণের সেবায় সবসময় নিজেকে উৎসর্গ করতে চান।